বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২

আশুরা দিবসের কিছু অলৌকিক ঘটনা

মাজিদুর রহমান
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর -০০০১, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৫ এএম
আশুরা দিবসের কিছু অলৌকিক ঘটনা

হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। মহররম শব্দের অর্থ সম্মানিত। কারবালার শোকাবহ পর্বটি ছাড়াও এই দিনে আরও বহু অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই দিনটিতে সৃষ্টি করা হয় আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে। এই একই দিনে তাকে বেহেশতে পাঠানো হয়, বেহেশত থেকে দুনিয়ায় অবতরণ করানো হয়, হাওয়ার সঙ্গে তাকে আরাফাতের ময়দানে একত্র করা হয় ও তাদের ভুলত্রুটি মার্জনা করা হয়।

নমরুদের বাহিনী যখন মুসলিম জাহানের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে, আল্লাহ তার অশেষ মেহেরবানিতে সেখান থেকে তাকে মুক্তি দেন। একই দিনে হজরত মুসা কালিমুল্লাহ (আ.) নীল নদ পার হয়ে ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পান। ফেরাউন দলবলসহ নীল নদে ডুবে মারা যায়। এই দিনেই দীর্ঘ সময় প্রবল বন্যার পর হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকা জুদি পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে ঠেকে। তিনি ও তার অনুসারীরা বেঁচে যান। একই দিনে হজরত ইউনুস (আ.) রাতের অন্ধকারে, পানির গভীরে ও মাছের পেটে—এই তিন স্তরের অন্ধকার থেকে মুক্তি পান।

এই দিনেই হজরত আইয়ুব (আ.) সুদীর্ঘ ১৮ বছর রোগভোগের পর পূর্ণ সুস্থতা লাভ করেছিলেন। হজরত ইসা মাসিহ (আ.) এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহর অশেষ কুদরতে তাকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়, যা পবিত্র কোরআনে সুরা আলে ইমরানের ৫৫ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এই দিনেই হজরত মুসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে তুর পাহাড়ে গিয়ে কথা বলেন। আল্লাহর কাছ থেকে ঐশী গ্রন্থ তাওরাত লাভ করেন।

এই দিনেই হজরত ইয়াকুব (আ.) তার অতি স্নেহের সন্তান, হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বহুকাল পরে ফিরে পান। তার সন্তান হারানো বেদনার অবসান হয়। এই দিনেই হজরত সোলায়মান (আ.)-এর সিংহাসনে অভিষেক হয়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় তিনি সৈন্যসামন্ত নিয়ে এক মাসের ভ্রমণে বের হতেন, যা পবিত্র কোরআনের সুরা সাবার ১২ নম্বর আয়াতে উল্লেখ রয়েছে। এই দিনেই আল্লাহতায়ালা এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করেন।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলে করিম (সা.) হিজরত করে মদিনায় আসার পর দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা রাখে। নবী (সা.) কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এই দিনে হজরত মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইল শক্রবাহিনী থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন, তাই এই দিন হজরত মুসা (আ.)-এর শুকরিয়া আদায় করতে তারা রোজা রেখেছেন শুনে রাসুলে (সা.) বললেন, হজরত মুসা (আ.)-এর অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে বেশি হকদার। তাই এই দিনে তিনি রোজা রেখে অন্যদেরও রোজা রাখার হুকুম দেন।

হিজরি ৬১ সনের এই দিনেই নবীদৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার অনুসারীরা কারবালার ময়দানে ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন। এ ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।

ইসলাম ধর্মের বর্ণনামতে, কেয়ামতের দিন আশুরার দিন ঘটবে বলে হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা অনেক নবী ও তাদের অনুসারীদের বিভিন্ন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি দিয়েছেন। পবিত্র আশুরার দিনে আল্লাহতায়ালা আদম (আ.)-এর তওবা কবুল করেছিলেন।

এই ঘটনাগুলো পবিত্র আশুরার দিনকে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ববহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। আমরা যেন এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।

লেখক: মাদ্রাসা শিক্ষক

মন্তব্য করুন

স্মরণীয় মুসলিম মনীষী
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ইসলামী ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং ইসলামী ফিকাহ বা শরিয়াহর একজন মহান ইমাম। তার পূর্ণ নাম ছিল নুমান ইবনে সাবিত ইবনে জুয়াইন। তিনি হিজরি ৮০ সনে (৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে) ইরাকের কুফা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা সাবিত (রহ.) ছিলেন একজন সৎ, ধার্মিক ব্যবসায়ী এবং তার পূর্বপুরুষ পারস্যের অধিবাসী ছিলেন বলে জানা যায়। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেন যখন সাহাবায়ে কেরামদের অনেকেই তখনো জীবিত ছিলেন এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও অনুশাসন সরাসরি তাদের মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে প্রচারিত হচ্ছিল। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর চিন্তাধারার ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন, যিনি কুফা শহরে ইসলামী জ্ঞানের বিস্তার করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও ধর্মপ্রাণ। প্রথমদিকে তিনি তার পিতার মতো ব্যবসায়ে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আলেমদের সংস্পর্শে এসে তিনি জ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইলমে দ্বীন অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি বিশেষত হাদিস, তাফসির ও ফিকাহ শাস্ত্রে গভীর গবেষণা করেন। তার প্রধান ও প্রভাবশালী উস্তাদের নাম হলো ইমাম হাম্মাদ ইবনে আবি সুলায়মান। প্রায় ১৮ বছর তিনি তার সান্নিধ্যে থেকে ইলম অর্জন করেন এবং পরবর্তীকালে তার স্থলাভিষিক্ত হন। ইমাম আবু হানিফার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তার তর্কসংগত যুক্তিবোধ ও গভীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা। তিনি ফিকাহশাস্ত্রে কোরআন-হাদিসের পাশাপাশি কোরআন-হাদিসের নির্যাস মথিত নিজস্ব ‘রায়’ ও ‘কিয়াস’ (যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ)-এর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি ফিকাহকে একটি যৌক্তিক, শৃঙ্খলিত ও সহজবোধ্য কাঠামোতে পরিণত করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মতবাদ, যা হানাফি মাজহাব নামে পরিচিত, পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্বে অন্যতম প্রধান চারটি মাজহাবের একটি হিসেবে গৃহীত হয়। হানাফি মাজহাব বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তুরস্ক, মধ্য এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অঞ্চলে বহুল প্রচলিত। ইমাম আবু হানিফা শুধু একজন বড় মুফতি ও ইমামই ছিলেন না, বরং একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবেও খ্যাত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরহেজগার, সত্যবাদী ও ন্যায়পরায়ণ। তিনি রাজদরবারের প্রভাব থেকে দূরে থাকতেন এবং খলিফাদের পক্ষ থেকে বিচারপতির পদ প্রস্তাব পেলেও তা গ্রহণ করেননি। আব্বাসীয় খলিফা মানসুর তাকে যখন কাজির (বিচারপতি) পদে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি তা অস্বীকার করেন এবং এর ফলে তাকে কারাবন্দি করা হয়। কারাগারেই তিনি শেষ জীবন অতিবাহিত করেন এবং সেখানেই ১৫০ হিজরিতে (৭৬৭ খ্রিষ্টাব্দে) তার ইন্তেকাল হয়। মৃত্যুর পর কুফা শহরে লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে, যা ছিল তৎকালীন ইতিহাসে এক বিরল দৃশ্য। তার ছাত্রদের মধ্যে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.), ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ও জুফার ইবনে আবি ইউনুস ছিলেন উল্লেখযোগ্য, যারা হানাফি মাজহাবকে সুসংগঠিত ও সমৃদ্ধ করেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর রেখে যাওয়া জ্ঞানের ভান্ডার শুধু তৎকালীন সমাজে নয়, বরং আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং মুসলিম উম্মাহর ফিকাহ ও ধর্মীয় অনুশাসনের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তার অবদান চিরকাল মুসলিম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
স্মরণীয় মুসলিম মনীষী
আশুরা উপলক্ষে রোজা
হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররমকে ইসলামে পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। এ মাসের দশম তারিখে পুণ্যময় আশুরা। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার এই দিনটিতে মহৎ সুযোগ। যারা আল্লাহপ্রেমী তারা এই দিনে রোজা, নামাজ, জিকির, কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি ইবাদত করেন। ইহুদিরাও এই দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকে। পূর্বের নবীগণও এই দিনকে মূল্যায়ন করেছেন। এ মাসে নফল রোজা রাখার সওয়াব, অন্য সব নফল রোজার সওয়াবের চেয়ে বেশি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররমের রোজা।’ (মুসলিম: ১৯৮৯)। বিশেষভাবে আশুরা তথা মহররমের ১০ তারিখ অত্যন্ত তাৎপর্য এবং মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন। এই দিনে রোজা রাখার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এই দিনে রোজা রেখেছেন এবং স্বীয় উম্মতকে রোজা রাখার প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে রমজান এবং আশুরায় যেমন গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি, অন্য সময় তা দেখিনি।’ (বোখারি: ২০০৬) হজরত আলি (রা.)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এ প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছিলেন, রমজানের পর তুমি যদি রোজা রাখতে চাও, তবে মহররম মাসে রাখো। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহতায়ালা একটি জাতির তওবা কবুল করেছিলেন এবং ভবিষ্যতেও অপরাপর জাতির তওবা কবুল করবেন।’ (তিরমিজি: ৭৪১) মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখার পাশাপাশি এর আগে বা পরে একটি রোজা অতিরিক্ত রাখতে বলা হয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করে। তিনি তাদের বলেন, এই দিনটির এমন কী মাহাত্ম্য যে তোমরা রোজা পালন করো? তারা বলে, এই দিনে আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার জাতিকে মুক্তি দান করেন এবং ফেরাউন ও তার জাতিকে নিমজ্জিত করেন। এজন্য মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই দিন রোজা পালন করেছিলেন। তাই আমরা এই দিন রোজা পালন করি। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, মুসার (আ.) বিষয়ে আমাদের অধিকার বেশি। এরপর তিনি এই দিন রোজা পালন করেন এবং রোজা পালন করতে নির্দেশ প্রদান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইনশাআল্লাহ আগামী বছর আমরা মহররমের নবম তারিখেও রোজা রাখব। (মুসলিম: ১৯১৮) এ হাদিস থেকে বোঝা যায়, নবীজি (সা.) আমাদের বিজাতীয় সাদৃশ্য পরিহার করার শিক্ষা দিয়েছেন। তাই প্রথমত, আমাদের আশুরার রোজা একটির পরিবর্তে দুটি রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনের সবক্ষেত্রে অমুসলিমদের সাদৃশ্য অবলম্বন পরিহার করতে হবে। এর বাইরে আর যত কিছু আছে মাতম, মর্সিয়া, মিলাদসহ সবকিছুই বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। মিছিল, আতশবাজি ফোটানো, বিশেষ খাবার রান্না করা এসবের কোনো নিয়ম নেই। এ ছাড়া এই দিনের বিশেষ নামাজ, বিশেষ দোয়া-দরুদ বা আমল নেই। তবে স্বাভাবিকভাবে অন্যদিনের মতোই এদিন নফল আমল করতে পারবে। তবে নফল রোজার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। আল্লাহতায়ালা আমাদের মহররম মাসে বেশি বেশি রোজা রাখার এবং আশুরার তাৎপর্য অনুধাবন করে তদনুযায়ী আমল করার এবং সব ধরনের গুনাহ বর্জন করার তওফিক দান করুন। লেখক: ইমাম ও খতিব
আশুরা উপলক্ষে রোজা
কারবালা প্রান্তর এখন আধুনিক শহর
ইরাকের ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে যা ঘটেছিল, তা এক কথায় নির্মম, নিষ্ঠুর ও হৃদয়বিদারক। মহররম মাসের ১০ তারিখে এ ময়দানে সপরিবারে হত্যা করা হয় নবীদৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-কে। দুপুরের তপ্ত রোদে পানির পিপাসায় আটকে রেখে তীরবিদ্ধ করা হয় গলায়, তারপর আহত ইমামকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় পরিবারের নারী-শিশুদের চোখের সামনে। এ ঘটনা শুনলে অন্তর কেঁপে ওঠে যে কোনো মানুষের। মুসলমানদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়। ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মর্মান্তিক ঘটনা শুনলে চোখ দিয়ে পানি ঝরাবে না এমন কেউ নেই। সেদিন হজরত হোসাইন (রা.) উত্তপ্ত মরুভূমিকে বানিয়েছিলেন ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি। তাতে তিনি নিজ শরীরের রক্তকে কালি বানিয়ে রচনা করেছেন শোকের ইতিহাস। কারবালা প্রান্তরের হৃদয়বিদারক সেই ঘটনা আজও মানুষকে শোকাবহ ও বেদনার্ত করে। সেই কারবালা এখন কেমনÑপৃথিবীর মুসলমানসহ যে কোনো মানুষের কাছেই এটি কৌতূহলের বিষয়। হিজরি ৬১ সালে কারবালা ছিল ইরাকের ফোরাতের নদীর তীরবর্তী একটি জনশূন্য প্রান্তর। তিন পাশে মরুভূমি, পাহাড়, টিলা এবং একপাশে ফোরাত নদীর বহমান জলধারা। তবে কালের আবর্তে সেই কারবালা প্রান্তর আর ফাঁকা নেই। সেখানে গড়ে উঠেছে আধুনিক তিলোত্তমা শহর, রোডঘাট, মার্কেট, শপিং মল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকাসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধার একটি জনপদ। কারবালা বর্তমান ইরাকের মধ্যবর্তী একটি শহর। রাজধানী বাগদাদ থেকে ১০৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে কারবালার অবস্থান। বাগদাদ থেকে ট্রেনে করে কারবালা যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে কারবালার উচ্চতা ৩০ মিটার উঁচুতে। ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কারবালা প্রদেশের মোট জনসংখ্যা ৭০ লাখ। এ শহরে ইমাম হোসাইন (রা.) ও আব্বাস ইবনে আলির কবর রয়েছে। প্রাচীনকালে এ শহরের নাম ছিল কোর-বাবিল। কারণ, প্রাচীন ব্যাবিলনীয় কিছু গ্রামের সমষ্টিগত নাম ছিল এটি। তখনকার বাবিল শহরের কথা আল্লাহতায়ালা প্রসঙ্গক্রমে পবিত্র কোরআনেও উল্লেখ করেছেন। কিছু ঐতিহাসিক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কারবালা নামটি এসেছে আরবি ‘কারব’ (অর্থাৎ বিপদ-যন্ত্রণা) ও ‘বালা’ (অর্থাৎ বিয়োগান্ত-দুর্বিপাক) শব্দ থেকে এসেছে। এখানকার জমিনে ৬১ হিজরিতে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের মর্মন্তুদ ও শোকাবহ ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। ২০০৩ সালে মার্কিন যুদ্ধের কারণে ইরাকে প্রভাব ফেললেও কারবালায় কিছুটা কম পড়েছে। ফলে কারবালা শহরটি বেশ সাজানো-গোছানো ও পরিপাটি। কারবালার লোকজনও অনেক সচেতন। যত্রতত্র তারা ময়লা-আবর্জনা ফেলে না। শহরকে দৃষ্টিনন্দন ও মনোমুগ্ধকর করে রাখতে তারা যথেষ্ট সতর্ক থাকে। বিভিন্ন দেশ ও শহর থেকে আসা [ইমাম হোসাইন (রা.)-এর কবর জিয়ারত করতে] লোক ও পথচারীর জন্য পথেঘাটে পানীয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থস্বল্প লোকদের বিনামূল্যে কারবালায় যাতায়াতের জন্য মিনিবাস, অটোগাড়িসহ অন্যান্য যানবাহনের ব্যবস্থা রয়েছে। গাধার গাড়ি এখানকার জনপ্রিয় যাত্রাবাহন। কারবালার রাস্তায় উটও দেখা মেলে অনেক। সাতসকালে বিভিন্ন যানবাহনে করে দূর-দূরান্ত থেকে নারী-পুরুষ কারবালায় খাদ্যসামগ্রী বিক্রি করতে আসে। সন্ধ্যারাত থেকে কারবালার মসজিদগুলোর পার্শ্ববর্তী ফুলবাগানগুলোয় আলোকবর্তিকা জ্বলে ওঠে। বিভিন্ন রঙের আলোর পসরা উজ্জ্বলতা ছড়ায় আশপাশে। তখন মসজিদগুলোর আঙিনা নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে। নামাজের আগে স্থানীয় লোকজন এসে সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় মেতে ওঠে। ইরাকে বসন্তকাল দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় কারবালা বছরের অনেকটা সময় ফুলে-পুষ্পে সুশোভিত থাকে। বাড়িঘরের আঙিনার গাছগুলো অনেক দিন ফুলে ছেয়ে থাকে। মাঠ-ময়দান সবুজাভ হয়ে থাকে। অন্যদিকে শহরের বাইরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে সারি সারি খেজুরবীথি রয়েছে। বাগানে উৎপন্ন খেজুরগুলো দেশের বিভিন্ন শহরের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দুয়েকটা দেশেও রপ্তানি করা হয়। অবশ্য আরব দেশ হিসেবে কারবালায় মরু-অঞ্চলও রয়েছে। রয়েছে সারি সারি বালুর ঢিবি। তবে সবকিছু মিলিয়ে কারবালা অনেক সুন্দর ও মনোরম শহর। ইমাম হোসাইন (রা.) এর কবর, তিল্লে জায়নাবিয়া, হজরত আব্বাস ইবনে আলির কবর, বিখ্যাত ফোরাত নদী ইত্যাদি কারবালার রূপ-সৌকর্যে কনকশোভা যোগ করেছে। এ ছাড়া ভাস্কর্য, পার্ক, শপিং মল, রেস্তোরাঁ এবং বাহারি ফুলের বাগানে সমৃদ্ধ কারবালা এখন আধুনিক ও মনোরম একটি শহর।
কারবালা প্রান্তর এখন আধুনিক শহর
আশুরার মাহাত্ম্য ও কারবালার ইতিহাস
আশুরা ও কারবালা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। ‘আশুরা’ আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘দশম’। মহররম মাসের দশম দিবসকে বলা হয় আশুরা। আর মহররম হচ্ছে হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। মুসলমানদের বছর গণনার প্রথম মাসের দশম দিবসটি সৃষ্টির শুরু থেকেই নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। আশুরা দিবসের সর্বশেষ সংযোজন কারবালা প্রান্তরের এক মর্মান্তিক ঘটনা। ইসলামের আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই এ দিনটি ছিল পবিত্র ও সম্মানিত। প্রাচীন আরবের রীতিতে যে মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম ছিল, তন্মধ্যে মহররম অন্যতম। আল্লাহ নিজেই এ মাসকে ‘মর্যাদাপূর্ণ’ বলে ঘোষণা করেছেন। ‘মহররম’ শব্দের অর্থও সম্মানিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে গণনা হিসাবের মাস হলো ১২টি। যেদিন থেকে তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এর মধ্যে চারটি মাস বিশেষ সম্মানিত।’ (সুরা তাওবা : ৩৬)। এই আয়াতের তাফসিরে বলা হয়েছে, ‘১২ মাস হলোÑ মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো মহররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। এ মাসেরই দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরা মানে দশম দিবস। তবে এই আশুরাকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। শিয়ারা আশুরার আবহমান কালের সব তাৎপর্য-মহিমা বাদ দিয়ে কেবল কারবারার মর্মান্তিক ঘটনায় শোক প্রকাশকেই প্রধান ইবাদত হিসেবে ধরে নিয়েছে। তারা ধারণা করে, নবীজির দৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.)-এর প্রেমে রক্ত ঝরানোই প্রকৃত ইসলাম। আশুরা দিবসের ইতিহাস কারবালায় ইমাম হুসাইন (রা.)-এর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির বহু পূর্ব থেকেই আশুরার গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত। এ দিনে হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়, হজরত নূহ (আ.) মহাপ্লাবনের শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন, হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে অগ্নিকুণ্ড থেকে মুক্তি দেওয়া, হজরত মুসা (আ.) তুর পর্বতে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন, তাঁর শত্রু ফেরাউনের নীল নদে ভরাডুবি হয়। এই দিনে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগ থেকে মুক্তি পান। হজরত ইয়াকুব (আ.) তার প্রিয় পুত্রকে ফিরে পান। হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে দজলা নদীতে বের হয়েছিলেন এই দিনে। হজরত সুলাইমান (আ.) এই দিনে পুনরায় রাজত্ব ফিরে পান। হজরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং তাঁকে আকাশে তুলে নেওয়া হয় এই দিনেই। হজরত জিব্রাইল (আ.) সর্বপ্রথম আল্লাহর রহমত নিয়ে রসুল (সা.)-এর কাছে আগমন করেছিলেন। মহররমের কোনো এক শুক্রবার ইস্রাফিল (আ.)-এর সিঙ্গায় ফুৎকারের মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস হবে। নবীজির ইন্তেকালের কয়েক দশক পর ৬০ হিজরি সালে এ দিনেই প্রিয় নবীর (সা.) প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে স্বপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্যতম বর্বর হত্যাকাণ্ডে মেতে ওঠে ইয়াজিদের পিশাচ বাহিনী। কারবালার ঘটনা নিঃসন্দেহে জঘন্যতম এক ঘটনা। এ ঘটনা আমাদের শেখায় হকের পক্ষে অবিচল থাকার, ত্যাগ ও আত্মত্যাগের এবং জালিমের সামনে মাথা নত না করার শিক্ষা। তবে ইসলামে আশুরার মাহাত্ম্য কেবল এ কারণে নয়। কারবালা প্রান্তরের ইতিহাস মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসেবে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) ২০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পর ৬০ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে মজলিশে শুরা ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে তিনি তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী শাসক হিসেবে মনোনয়ন দেন। তার মৃত্যুর পর ইয়াজিদ খেলাফতের দাবি করলে তৎকালীন মুসলিম বিশে^র কিছু এলাকার মানুষ তা মেনে নেন। পক্ষান্তরে মাদিনার অধিকাংশ মানুষ, ইরাকের অনেকে বিশেষ করে কুফার জনগণ তা মানতে অস্বীকার করেন। কুফার জনগণ নবী-দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.) কে খলিফা হিসেবে গ্রহণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কুফার লক্ষাধিক মানুষ ইমাম হোসাইনকে খলিফা হিসেবে বাইয়াতপত্র প্রেরণ করেন। এই পত্রে তারা দাবি করেন, সুন্নাহ পুনর্জীবিত এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে অবিলম্বে তার দায়িত্ব গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে মদিনায় অবস্থানরত সাহাবিরা এবং ইমাম হোসাইনের নিকটাত্মীয়রা ইমামকে কুফায় যেতে বারণ করেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছিলেন, ইয়াজিদের পক্ষ থেকে বাধা আসলে ইরাকবাসী ইমাম হোসাইনের পক্ষ ত্যাগ করবে। এমতাবস্থায় ইমাম হোসাইন (রা.) তার চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে ইরাকের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করেন। তাকে তিনি এই নির্দেশ প্রদান করেন যে, যদি সে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে এবং ইরাকবাসীদের অন্তরকে সুদৃঢ় ও সুসংহত পায় তাহলে যেন তার কাছে দূত প্রেরণ করে। মুসলিম ইবনে আকিল কুফায় আগমন করার সাথে সাথে ১৮ হাজার কুফাবাসী তার কাছে এসে ইমাম হোসাইনের পক্ষে বাইয়াত গ্রহণ করে। এবং তারা শপথ করে বলে, অবশ্যই আমরা জানমাল দিয়ে ইমাম হোসাইনকে সাহায্য করবো। তখন মুসলিম ইবনে আকিল ইমাম হোসাইন (রা.) এর নিকট পত্র পাঠিয়ে জানালেন যে, কুফার পরিস্থিতি সন্তোষজনক, তিনি যেন আগমন করেন। এই সংবাদের ভিত্তিতে ইমাম হোসাইন (রা.) তার পরিবারের ১৯ জন সদস্যসহ প্রায় ৫০ জন সঙ্গী নিয়ে কুফার উদ্দেশে রওনা হন। এই খবর ইয়াজিদের নিকটে পৌঁছালে কুফার গভর্নর নোমান ইবনে বশির (রা.)-কে পদচ্যুত করে ওবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদকে কুফার গভর্নরের দায়িত্ব প্রদান করেন। এবং তাকে এই মর্মে নির্দেশ দেন, ইমাম হোসাইন (রা.) যেন কোনোভাবেই কুফায় প্রবেশ করতে না পারে। ওবায়দুল্লাহ বিন জিয়াদ কুফায় পৌঁছে সেখানকার জনগণকে কঠোর হস্তে দমন করে এবং মুসলিম বিন আকিলকে হত্যা করে। এরপর ইমাম হোসাইন (রা.) কে প্রতিরোধ করতে চার হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরণ করে। ইবনে জিয়াদের বাহিনী কারবালার প্রান্তরে অবরোধ করলে হোসাইন (রা.) বললেন, আমি তো যুদ্ধ করতে আসিনি। তোমরা আমাকে ডেকেছো বলে আমি এসেছি। এখন তোমরা কুফাবাসীরাই তোমাদের বাইয়াত পরিত্যাগ করছ। তাহলে আমাদেরকে যেতে দাও, আমরা মদিনার ফিরে যাই অথবা সীমান্তে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি অথবা সরাসরি ইয়াজিদের কাছে গিয়ে তার সাথে বোঝাপড়া করি। কিন্তু ইবনে জিয়াদ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেয়। ইমাম হোসাইন (রা.) ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর আশুরার দিন (১০ মহররম) সকাল থেকে ইবনে জিয়াদের বাহিনী হোসাইন (রা.) এর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে এবং ফোরাত নদী থেকে পানি সংগ্রহের সকল পথ বন্ধ করে দেয়। হজরত হোসাইন (রা.) এর শিবিরে শুরু হয় পানির জন্য হাহাকার। হোসাইন (রা.) বাতিলের কাছে মাথা নত না করে সাথীদের নিয়ে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। এই যুদ্ধে একমাত্র ছেলে হজরত জায়নুল আবেদিন (রহ.) ছাড়া পরিবারের শিশু, কিশোর ও মহিলাসহ পুরুষ সাথীরা সবাই একে একে শাহাদাতের অমিয়সুধা পান করেন। মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত ইমাম হোসাইন একাই বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত নির্মম ও নির্দয়ভাবে ইমাম হোসাইনকে শহীদ করা হয়। সিনান বা শিমার নামক এক পাপিষ্ঠ তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। শাহাদাতের পর ইমাম হোসাইন (রা.) এর ছিন্ন মাথা বর্শার ফলকে বিদ্ধ করে এবং তার পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে দামেশকে ইয়াজিদের নিকট প্রেরণ করা হয়। ইমাম হোসাইন (রা.) এর কর্তিত মাথা দেখে ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পরে এবং বাহ্যিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করে বলে, আমি তো ইমাম হোসাইনকে শুধু কুফায় প্রবেশে বাধা দিতে নির্দেশ দিয়েছিলাম, তাকে হত্যা করার নির্দেশ দেইনি। এরপর তার পরিবার-পরিজনকে স্বসম্মানে মদিনায় প্রেরণ করা হয়। (সূত্র : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। ইয়াজিদের বাহিনী কারবালা প্রান্তরে জয়লাভ করলেও তারা মূলত পরাজিত হয়। ইতিহাস সাক্ষীÑ ইমাম হোসাইন ও তার সাথীদের হত্যায় জড়িত প্রতিটি ব্যক্তি কয়েক বছরের মধ্যেই মুখতার সাকাফির বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। মাত্র চার বছরের মধ্যে ইয়াজিদ মৃত্যুবরণ করে এবং তার পুত্রেরও কয়েকদিনের মধ্যে মৃত্যু হয়। এরপর আর কোনো দিন তার বংশের কেউ শাসন ক্ষমতা লাভ করেনি। কারবালার প্রান্তরে মহানবীর (সা.) দৌহিত্র হজরত হোসাইনকে (রা.) মর্মান্তিকভাবে শহীদ করার ঘটনা সত্যিই প্রতিটি মুমিনের গা শিউরে ওঠার মতো। এ রক্তক্ষয়ী বেদনাবিধুর হৃদয়বিদারক ঘটনা মুসলিম জাতির সর্বাধিক বিয়োগান্তুক ট্র্যাজেডির অন্যতম। বিশ্ব মুসলিমের কাছে ঐতিহ্যমণ্ডিত আশুরার দিনে অত্যাচারী ইয়াজিদ মানুষের জীবনের আনন্দকে হত্যা করতে চেয়েছিল। চেয়েছিল পবিত্রতাকে কলুষিত করতে। কিন্তু পাষাণ হৃদয়ের শিমারের খঞ্জর হজরত হোসাইন (রা.)-এর শিরোচ্ছেদ করলেও মানুষের মহত্ত¡ আর মহানুবতাকে হত্যা করতে পারেনি। বরং হক-বাতিলের আমৃত্যু লড়াই অব্যাহত রাখার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে কারবালার এ মর্মস্পর্শী ঘটনা। ত্যাগ ও তিতিক্ষার নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন নবী দৌহিত্র হজরত হোসাইন (রা.)। সেদিন হকেরই বিজয় হয়েছিল। ফলে ইতিহাসের সোনালি পাতায় ইমাম হোসাইন (রা.) আজও বেঁচে আছেন আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে। লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
আশুরার মাহাত্ম্য ও কারবালার ইতিহাস