বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২
কবি অমিয় চক্রবর্তীর সাক্ষাৎকার

আমরা অন্যের ওপর বিজয়ী হচ্ছি কিন্তু পরাজিত হচ্ছি ঘৃণার কাছে

তুহিন দাস
প্রকাশ : ৩০ নভেম্বর -০০০১, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:২২ এএম
আমরা অন্যের ওপর বিজয়ী হচ্ছি কিন্তু পরাজিত হচ্ছি ঘৃণার কাছে

১৯৬৫ সালের ১১ জুন আমেরিকায় শিকাগোর ডব্লিউএফএমটি রেডিওতে বাংলা ভাষার অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তীর প্রায় এক ঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। লেখক ও ইতিহাসবিদ স্টাডস টারকেলের নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটিতে গত শতাব্দীর ঘটনাবলি নিয়ে নানান কথা উঠে এলেও বর্তমানের যুদ্ধ-গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে তার কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। আমেরিকা থেকে এ রেডিও সাক্ষাৎকারটি সংগ্রহ করে কালান্তরের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন কবি তুহিন দাস

পর্ব: ৪

স্টাডস টারকেল: আপনার এ কথাগুলো বেশ দুঃখজনক। আমি নিশ্চিত আপনি সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, সম্ভবত খুব নেতিবাচকভাবে, রাস্তায় দেখা হওয়া সেসব মানুষরাও। আপনি বলছিলেন যে মানবতার কবর অনেক আগেই রচিত হয়েছে। কিন্তু পথের সে লোকটির কর্তৃত্বহীনতা ও অক্ষমতার অনুভূতি রয়েছে। আমাদের ভালো শিক্ষাদানকারীরা আছেন আর আছেন তাদের অনুসারীরা যারা সত্যের সন্ধান করছেন। তারা এ সাধারণ মানবতার কথা বোঝেন, যা আপনি বলছেন। হ্যাঁ, নৃশংসতা সেই ধরনের অমানবিকতা যার কথা আপনি বললেন—তার আকাঙ্ক্ষা আছে ওই মেলার প্যাভিলিয়নগুলোতে। লোকটা জাপানি, ভারতীয় বা ভিয়েতনামীদের দেখে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু এ শর্তগুলোতে স্তরের পর স্তর রয়েছে…

অমিয় চক্রবর্তী: এটা আমাদের কাজ। আমি নিশ্চিত যে, আপনিও একই রকম অনুভব করেন যখন আপনি কোনো পক্ষপাত বা প্রোপাগান্ডা ছাড়াই আপনার অদৃশ্য শ্রোতাদের কাছে সত্য প্রকাশ করেন। সংবাদ, রেডিও বা টেলিভিশনের মাধ্যমে আপনার কথার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরা একটি দুর্দান্ত কাজ এবং আমরা বলছি না যে আমরা দেশপ্রেমিক নই। আমরা আমাদের দেশকে ভালোবাসি, আমাদের দেশের লোককে ভালোবাসি। কিন্তু সেই গর্বের সঙ্গে অন্য মানুষের অধিকারগুলোর স্বীকৃতিও জড়িত। আমরা এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারি। কীভাবে, আমরা তা জানি না। আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুর্দান্ত কাজ করছে, মনে হয় অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও, যেমন—কোয়েকার, ইউনিটেরিয়ান, প্রধান চার্চগুলো। ধারাবাহিকভাবে ক্যাথলিক চার্চগুলোর দরজা পোপ জনের সময় থেকে (মেয়াদকাল: ১৯৫৮-১৯৬৩) সুন্দর ও প্রশস্তভাবে খুলে দেওয়া হয়েছে। পোপ পল ভারত ভ্রমণ করেছেন (১৯৬৪) এবং তিনি অবাক হয়েছিলেন যে, তিনি যেখানেই গেছেন সেখানে ৯৮ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান ছিল না। তিনি ভাবছিলেন কেন তারা আমাকে দেখতে এসেছে? ওহ, আপনি একটি মহান বিশ্বাসের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন, এটা তো এক বিরাট আনন্দের ব্যাপার! তারা অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। তার কাছে এটি একটি অসাধারণ ব্যাপার ছিল যে, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ একে অন্যের সম্পর্কে এরকম অনুভব করতে পারে। আমাদের কাছে থাকা রেডিও, সংবাদপত্রের মতো বিভিন্ন মাধ্যমেও এটি ঘটছে। সবকিছু একটি মাধ্যমে পাওয়া যায় না—মুদ্রিত বই, লিখিত শব্দমালা, মানুষের সাক্ষাৎ, নিউইয়র্কের বিশ্বমেলা—আমরা মানুষের জন্য যে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারি: একসঙ্গে খাওয়া, একসঙ্গে গান শোনা, একে অন্যের বাড়িতে আসা-যাওয়া। তবে অবশ্যই আমি জানি আমরা একটি সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির কথা বলছিলাম। এটা একরকম মন শক্ত হয়ে যাওয়া, ধমনি শক্ত হওয়ার মতো। মানসিক স্থবিরতা শারীরিকভাবে স্থবির হওয়ার রোগের চেয়েও অনেক খারাপ। এর নিরাময় করতে হবে। আমরা কীভাবে আমাদের মনকে একটু চাঙা করতে পারি? সংগীত ও শিল্পের মতো মানবিক অনুষঙ্গের কাছে মনকে তুলে ধরুন। সত্যি বলতে, আমি খুব আশাবাদী, কারণ যখন এসব চলছে তখন নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন শিল্প জাদুঘরে চীনা শিল্পকর্মের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও সর্বাধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রদর্শনীগুলোর মধ্যে একটি চলছে এবং সেখানে হাজার হাজার দর্শক চীনা শিল্পের অমর সৌন্দর্যের প্রশংসা করছিলেন। চীনারা নিজেরা নিজেদের প্রতিন্দ্বন্দ্বী। তারা আসলে অসাধারণ সৌন্দর্য ও শিল্পের স্রষ্টা। এখন তারা বলবে আজকের চীনারা এর চর্চা করছে না। আমি বলব, আপনি কি নিশ্চিত যে চীনাদের সবাই এটা করছে না? তখন বলবে, ওহ, আমি সরকারের কথা বলছি! আমি বলব, ঠিক আছে, তবে আপনি এরই মধ্যে একটি বড় কথা বলে ফেলেছেন! সেখানকার জনসাধারণ কিন্তু আপনার আর আমার মতোই। আমাদের ভুল যখন বোমা হামলার দিকে অগ্রসর হয়, তখন আসলে আমরা শিকারকেই শিকার করছি। যদি সরকার খারাপ হয়, তাহলে প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই দেশের মানুষ। আমরা তাদের কী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি? লাখ লাখ মৃত্যু।

স্টাডস টারকেল: আমরা নিজেরা নিজেদেরই শিকার করছি। আবার ফিরে আসি রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন ও গান্ধী প্রসঙ্গে। মানুষ হিসেবে তারা পৃথক ছিলেন, কিন্তু তারা ছিলেন একই মানবতায় পূর্ণ। এখন আমরা অনেক দক্ষ, আমাদের এতসব বোমারু বিমান আছে—আপনি জানেন যে আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, আসুন আমরা অতীতের মতবাদগুলো থেকে নিজেদের মুক্ত করি। আমরা কি সেসব দ্বারা মোহগ্রস্ত হই না? আমরা যা যা করে চলেছি তা যদি করেই চলি যেমনটা আপনি বললেন, তাহলে কি আমরা নিজেরা বিলীন হয়ে যাব না?

অমিয় চক্রবর্তী: এটা আমাকে বরিস পাস্তেরনাকের সঙ্গে কাটানো এক গৌরবময় দিনের কথা মনে করিয়ে দেয়। মস্কোর পেরেডেলকিনো নামক স্থানে (রাশিয়ায় অবস্থিত, সোভিয়েত লেখকদের বসবাসের জন্য স্থাপিত গ্রামে) তিনি থাকতেন, সেখানে তার মৃত্যুর (মে, ১৯৬০) তিন মাস আগে আমাদের দেখা হয়েছিল। আর এ মানুষটি ছিলেন এমন একজন যিনি সব ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে গেছেন। এ প্রসঙ্গে আপনি উল্লেখ করতে পারেন যেমন নাৎসি আক্রমণ, প্রথম (১৯১৪-১৯১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫), অক্টোবর বিপ্লব (১৯১৭, রাশিয়া)। কিন্তু তিনি একজন দয়ালু বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। আপনি যদি তার মুখের মায়া দেখতে পেতেন! আমার মনে পড়ছে তার লেখা ‘ডক্টর জিভাগো’ উপন্যাসের শেষে সংযুক্ত তার একটি কবিতা (শিরোনাম ‘ভোর’) যেখানে তিনি প্রথম পুরুষ একবচনে এরকম বলেছেন—আজ সকালে আমি রাস্তায় লোকজনের দিকে তাকালাম, তারা তাদের অফিসে যেতে তাড়াহুড়ো করছে, রাস্তায় প্রচুর তুষার, বাচ্চারা তুষারের বল নিয়ে খেলছে, এখনো অনেকে ঘরে বসে আছেন। তারা আমার থেকেও বিজয়ী যারা ভালোবাসার দ্বারা জয়ী হয়।

মানবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে নিজেকে জয়ী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার মধ্যে প্রকৃত বিজয় নিহিত আছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, যদি আমরা তা না করি, তাহলে এর উল্টোটা ঘটে। আমরা অন্যের ওপর বিজয়ী হচ্ছি, কিন্তু পরাজিত হচ্ছি ঘৃণার কাছে। আমরা যে সত্য ধারণ করি, তার মাধ্যমে উন্নত হওয়ার বদলে, আমাদের মধ্যে থাকা মন্দতায় ক্ষুদ্র হয়ে যাচ্ছি। এর জন্য সবচেয়ে কঠিন মূল্য পরিশোধ করতে হয় এবং অনেক মানুষ জানে না যে তারা কী মূল্য পরিশোধ করছে। তারা শুধু নিজেরাই নয়, বরং শিশুদেরও মূল্য পরিশোধ করতে বাধ্য করছে। আপনি যদি কার্টুনের পৃষ্ঠাগুলো দেখে থাকেন, তাহলে দেখবেন যে সন্দেহজনক চরিত্র ও খারাপ মানুষদের চিবুকের হাড়গুলো মঙ্গোলিয়ানদের মুখের মতো উঁচু, আপনি প্রায়ই এটি দেখতে পাবেন। এমন আবহ সৃষ্টি করে একটি নির্দিষ্ট জাতিকে মানবজাতির প্রধান শত্রু হিসেবে একটি ভাবমূর্তি তৈরি করা হচ্ছে। এই শিশুদের ছড়া ও পাঠ্যবইয়ের মধ্যে ঢোকানো হয়েছে। জার্মানরা ও ফরাসিরাও একে অন্যের সঙ্গে এটি করেছিল, তারা শিশুদের পাঠ্যবইয়ে এসব অদ্ভুত ধারণা ঢুকিয়েছে। তাহলে এখন কাদের পরাজিত করছে? উত্তর প্রজন্মকে। বাচ্চারা যে দুধ খাচ্ছে, তাতে তারা এক ফোঁটা বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। এখন এটা ওদের মেরে ফেলছে না, কিন্তু ধীরে ধীরে ওদের বিবেক ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের সন্তানদের, নিজেদের, দেশের নাগরিকদের জন্য কি আমরা কেউ এই মূল্য দিতে চাইব? আপনার কথাটা আমি খুবই গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছি। চূড়ান্ত পরাজয় হলো মন্দের কাছে আত্মসমর্পণ করা ও আমাদের মনুষ্য-স্বভাবকে হ্রাস করা। আমরা যতই কার্যকরী হই না কেন, ট্রিগার টানার বা বোতাম টেপার কথা আমরা চিন্তা করি। আসলে আনন্দ করার আর কিছু নেই, কারণ ওই বোতামটিতে চাপ পড়লেই হয়তো আমার মতো অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হবে। এ ধরনের ঘটনার এই দৃশ্যে আমি কি আনন্দ পেতে পারি? এমনকি এমন একটি ঘটনার সম্ভাবনা দেখেও। আমি জানি পৃথিবীর কোথাও মানুষ এত খারাপ নয়। তারা এটা চায় না, কিন্তু তারা নিজেদের এমন একটা মানসিক অবস্থার মধ্যে নিয়ে গেছে যখন তারা মনে করে ‘এটা একটি প্রয়োজনীয় মন্দ’। আমি এ বাক্যাংশটির বিরোধিতা করি। যদি এটি মন্দ হয়, তবে এটি প্রয়োজনীয় হতে পারে না।

স্টাডস টারকেল: যেমনটা আপনি বললেন, আপনার প্রসঙ্গে আমাকে অবশ্যই বলতে হবে, ম্যাক্স ফ্রিডম্যান নামে একজন লেখক আছেন যিনি শিকাগো ডেইলি নিউজ পত্রিকায় লিখে থাকেন এবং আমার মনে হয় ফ্রিডম্যান ওয়াশিংটন থেকে লেখেন। তার লেখার নিজস্ব রচনাশৈলী রয়েছে। তিনি লুইস মামফোর্ডকে আক্রমণাত্মক আচরণের জন্য নিন্দা করেছেন, যিনি হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিতব্য শিল্প-সাহিত্য উৎসবে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

অমিয় চক্রবর্তী: রবার্ট লোওয়েল একাডেমিতে (আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস) ভাষণ দিয়েছিলেন এবং একই কথা বলেছিলেন। (ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন প্রেসিডেন্টের বাসভবনে অনুষ্ঠিত আর্টস ফেস্টিভ্যাল কিছু আমন্ত্রিত ব্যক্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করেন। স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার জন্য বিখ্যাত কবি রবার্ট লোওয়েল তখন ছিলেন আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটারসের প্রেসিডেন্ট)। [চলবে]

মন্তব্য করুন

স্বপ্ন থেকে যাক কেবল স্বপ্নই
স্বপ্ন থেকে জেগে আবার ঢুকে যাই আরেক স্বপ্নেই, স্বপ্নে ঘুরিফিরি, স্বপ্নে ডুবে আছি আপাদমস্তক; স্বপ্নচারিতায় ভুলেছি চিরতরে কোথায় ঘরবাড়ি, পেরোলে চৌকাঠ এপারে রঙধনু, ওপারে শূন্যতা। স্বপ্ন সুধামাখা, মিথ্যে জাগরণ—কেবল চেয়ে-থাকা; স্বপ্ন দূরগামী, মানে না সীমারেখা, অসহ ঘেরাটোপ। স্বপ্ন জলযান, নিজেই কাণ্ডারী, নিজেই গতিপথ, স্বপ্ন বাতিঘর, দূরের মঞ্জিল, প্রাজ্ঞ পাঞ্জেরী। স্বপ্ন দেখে-দেখে, স্বপ্ন ফেরি করে সতত জেগে রই— যাবো না ফিরে আর, স্বপ্ন থেকে যাক কেবল স্বপ্নই! হালকা পদ্যে ছলাৎ ছল টোকন ঠাকুর গাছ জানে না, আমি কোথায় থাকি? মাছ জানে না, আমি একটা পাখি! পাখি জানে না, আমি তাদের কেউ ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ জানে না, আমিও একটা ঢেউ! কিন্তু আমি ফুলের বনে একটু বহে যাওয়া ভাবতে পারো আদর আমি একপশলা হাওয়া হয়তো আমি এর বাইরেও অন্য কিছু হয়ে মোমের মতো পুড়তে পুড়তে, নিজে নিজেই ক্ষয়ে একটুখানি আলোর পাশে তোমাকে দেখি, তুমি তুমি কে আবার—কবিতা থেকে বেরিয়ে যাও এক্ষুনি এতক্ষণ বেশ ভালোই ছিলাম নিজের মধ্যে শুরুতে ছিল গাছ-পাখি-মাছ, ধরনধারণ হালকা পদ্যে  সে যাই হোক, এখন কিন্তু থামতে হবে, ‘থামো রাত ৩টা, শোবো, ও ছাত্রী-ভূত মস্তক হইতে নামো।’ বিভাজন এহসান হায়দার দূরের সাইকেল ফেরে নিকট চলে যায় দূরে—পাখি ওড়ে কাছে থাকে না কিছুই; মৌমাছির মধুবিত্তান্ত বিভাজনেরই মন্দির, মসজিদ ধর্মালয়—কিছু নয় ক্ষুধার ভেতর বাড়তে থাকে প্রেম দু-একটা মাছ ভাজার স্বস্তি শিশুকালে যারা শান্ত ছিল দৃঢ় সে বিভাজনের ধারা দূরের সাইকেল চাকা হয়ে ফেরে জল মহিম সন্ন্যাসী কেমন অন্ধকার পায়ে চন্দ্রনগর থেকে চাঁদপুর হেঁটে চলেছিস আমরা তো চিৎ হয়ে শুয়ে আছি পেনসিল টর্চের বিপরীতে কাচের ডোবায় একটি তুলকালাম মার্বেল আমাদের প্রাণ ঘেঁষে ছুটে যায় নিশিপল্লীতে যেখানে ভরদুপুরে শব্দপুতুল নিয়ে খেলা করে বধির কিশোরী পরাজিত ডুবুরিরা সর্বজয়ার ঝোপে আগুন জ্বালায় কবি ও ধার্মিকরা দোয়া ইউনুস পড়ে পরম বোয়াল হয়ে ওঠে এসব হলুদ গ্রামে গবাদি মরিচখোর, মৎস্যাদি মৌমাছিভুক বন্যহাতির পায়ে দুধের পায়েস ঢালে ইমাম সাহেব সার্কাসবালিকার মাত্রাবৃত্ত থেকে খসে পড়ে কাঁচুলি ও মুক্তাক্ষর। তুই যে এমন বোকা—লাশের জন্মদিনে জীবিত লোকের হাতে উপহার দিস নিহত গরুর চাপে ঘাসের মৃত্যু দেখে আমরা কজন হেসে উঠি তোর হাতে শোভা পায় কান্নার মালামাল, শোকের জিনিস।
স্বপ্ন থেকে যাক কেবল স্বপ্নই
ঋতুরূপা তালুকদারের ‘শক্তির রূপরেখা’
সম্প্রতি সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে আয়োজিত হয়ে গেল শিল্পী ঋতুরূপার তালুকদারের চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ‘শক্তির রূপরেখা’। লড়াই, শক্তি ও মুক্তির পথে ধীরপায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো এক বিশাল আঙিনা তৈরি করেছেন শিল্পী ঋতুরূপা তালুকদার তার প্রদর্শনীর ঘরটিকে। গ্যালারির দেয়ালে দেয়ালে শক্তির দেবী কালীর বিচিত্র রূপ আর ভঙ্গিমা। কখনো অসহায় মায়ের মতো দেবীর মুখে মেঘের ছায়া পড়ে, আবার সে ছায়াই অস্ত্রের ঝঙ্কারে বর্ষিত হয় অসুরের গায়ে। কখনো স্বৈরশাসকের মুণ্ডু হাতে প্রতিবাদী সৌরঝড় আছড়ে পরে প্রাচীন মহাকাশে। এই লড়াইয়ের অস্ত্রই আবার রূপান্তরিত হয় পাখিতে, মুক্তির ডানা মেলে শান্ত শিশুর মতো খুঁজে বেড়ায় আশ্রয়। শক্তিকে রূপরেখায় প্রকাশ করতে গিয়ে ঋতুরূপা দেবী কালীকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার প্রতিটি আঁচড়ে, এচিংয়ের প্লেটে। আঁচড় কেটে যাওয়া এচিংয়ের প্লেটখানিও অস্ত্রের রূপে প্রদর্শনীতে সরাসরি উপস্থিত হয়েছিল। অসহায়ত্বের বিপরীতে দেবী কালীর মতো শক্তির আবির্ভাব হোক প্রতিটি মায়ের মনে, শিল্পী তাই আশা করেন। ঋতুরূপার নিজের পারিবারিক আধ্যাত্মিকতার চর্চার পথ রূপান্তরিত হয় শিল্পের দ্বারে। কালীর উগ্র কিন্তু করুণাময়ী রূপ এখানে ছায়ার মতো নরম মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে শিল্পীর চিত্রপটে। সেইসঙ্গে দর্শকেরও মনের উর্বর মাটিতে মুক্তির বীজ পুঁতে দেয়। ধীরে ধীরে মনে গেঁথে যায় তীব্র গতিতে হেঁটে চলা দেবী কালীর মৃত্যুঞ্জয়ী পায়ের ছাপ। চারুকলায় মাস্টার্সের শিক্ষাজীবনে নিজের একাগ্রচিত্র সাধনার মধ্য দিয়ে ঋতুরূপা তালুকদার এচিং মাধ্যমে অনেকগুলো কাজ করেছিলেন, সেখানেই শুরু হয়েছিল দেবী কালী চরিত্রের আবির্ভাব। ছবিগুলোতে নেই খুব বেশি রঙের উপস্থিতি। শুধু কালো আর লাল রং—যেন আমাদের টেনে নিয়ে যায় পুরাণের আদিম গন্ধমাখা সময়ে। শিল্পী যেন এ সময়ের ডালে প্রাচীন আর অর্বাচীনের মিশেলে ফুটিয়েছেন নতুন ফুল। এ সমাজে নারীদের মানসিক চাপ, অবহেলা, অসহায়ত্বকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মা কালীকে দাঁড় করালেন বিরোধী অসীম শক্তির বেদিতে। নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠটিকে রূপ দিয়ে আঁকলেন খড়গ, চাপাতি। আবার সেই খড়গই মুক্তির জয়গান গেয়ে কখনো মাছ বা পাখিতে রূপান্তরিত হলো। এখানে দেবী কালী আসলে একজন মৃত্যু ও সময়ের দেবী, আবার একজন করুণাময়ী মা। তিনি বিপ্লবী সত্তা হিসেবেও পরিচিত। তবে প্রদর্শনীতে এর বাইরেও শিল্পীর ভিন্ন ধারার কিছু কাজও স্থান পেয়েছিল। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগে বার্ষিক প্রদর্শনীতে সফিউদ্দীন ‘গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড’প্রাপ্ত শিল্পী ঋতুরূপা তালুকদারের এ প্রদর্শনীটি আয়োজিত হয়েছিল শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদের পারিবারিক উদ্যোগে।
ঋতুরূপা তালুকদারের ‘শক্তির রূপরেখা’
ঘুমিয়ে থাকা ঈশ্বর
ঢাকার নবাবপুর রোডে অবস্থিত শতাব্দীপ্রাচীন ভবনের সংস্কারকাজ চলছে। ভবনের নাম রণন কুঞ্জ। ভবনটি ছিল পুরোনো এক ব্যবসায়ীর বাড়ি, বহুদিন ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। তার সন্তান-সন্ততি এখন বাড়িটি মেরামত করে বিক্রি করার অভিপ্রায়ে আছে। বাড়িটির মালিক মারা গিয়েছিলেন অস্বাভাবিক মানসিক অবসাদের কারণে। বাড়ির দেয়ালে জমে আছে ছত্রাক আর মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। চারদিকে ধুমট ঝুলের গন্ধ। শ্রমিকরা যখন মাটির গভীরে পুরোনো কাঠামোগুলো সরাচ্ছিল, তখন আচমকাই মাটির অনেকটা গভীরে পাওয়া গেল একটি কালো পাথরের অদ্ভুত মূর্তি। মূর্তির নিচে সবার জন্য অপেক্ষা করছিল আরেক বিস্ময়—একটি গোপন কক্ষ, যার দরজাটি বাইরে থেকে সিল করে রাখা হয়েছিল পিতলের শিক ও লাল মোমের ও গালা সিলমোহর দিয়ে। দরজার গায়ে আঁকা ছিল ঘোলাটে সাদা রঙে অদ্ভুত চিহ্ন, যার ভাষা উপস্থিত কেউ চিনতে পারল না। কক্ষটি ভেঙে খুললে ভেতরে পাওয়া গেল একটি পাথরের বৃত্ত। বৃত্তের মাঝখানে সবাই দেখতে পান অচেনা ভাষায় লেখা একটি পাণ্ডুলিপি। মলিন, ছেঁড়া, অদ্ভুত আকৃতির দেখতে। খবর পেয়ে সেই বাড়িতে আসে একজন শিল্প-সংগ্রাহক। পেশায় তিনি স্থপতি, নাম নারায়ণ বিশ্বাস, যার অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহের শখ বহুদিনের। তিনি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সেই মূর্তটি চুপচাপ চাওয়া দামেই কিনে নিয়ে চলে যান এবং বাড়ির বর্তমান বংশধর নির্মাল্য দত্ত পাণ্ডুলিপিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করে দেন। নির্মাল্য দত্ত আমেরিকা প্রবাসী। যত দ্রুত সম্ভব তিনি নিজের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে এখান থেকে একেবারে আমেরিকা চলে যেতে চান। তাই মূর্তি বা পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে তিনি কোনো মাথা ঘামাতে চাইলেন না। যা হবে হোক, নির্মাল্য দত্ত জানেন তার পূর্বপুরুষরা এমন কিছু সত্তার উপাসনা করত, যার জ্ঞান বা ধারণা সাধারণ জানাশোনা জগতের বাইরে। এসবের ভয়েই ছোটবেলায় তিনি ও তার মা আমেরিকা পাড়ি জমান। এখানে, রণন কুঞ্জে থেকে যান তার বাবা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভাষা ও গ্রন্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা ইমতিয়াজ হাতে পান একটি পাণ্ডুলিপি। পাণ্ডুলিপিটির কোনো ভাষা চেনা যায় না, কিন্তু ছন্দ ও চিহ্নগুলো অদ্ভুত। আমাদের পরিচিত সব সভ্যতার কোনো ভাষার সঙ্গেও ভাষাগুলো মেলে না। শুধু এতটুকু বোঝা যায় যে, ভাষাটা মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকের মতো ছবিভিত্তিক। প্রথম কয়েক দিন রুমানা এটিকে পরীক্ষা করে দেখেন। অক্ষরগুলো স্থির নয়, কেমন যেন নড়াচড়া করে। একেকভাবে একেক কোণ থেকে দেখলে চিত্রগুলো বদলায়। মনে হচ্ছে অক্ষরের কাজ করা ছবিগুলো নিজ অক্ষের ওপর ঘুরছে। তার কানে একটা বিশাল সৌরঝড়ের শব্দ আসতে থাকে। একটা সময় তার ঘুম আসতে শুরু করে। তিনি ডেস্কের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নে দেখেন—অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক ছায়া। কিন্তু ছায়াটার একটা স্পন্দন আছে। কিছুক্ষণ ভালো করে দেখলে ছায়াটাকে কোনো নিউট্রন তারকা পালসার বলে ভুল হতে পারে। যার মুখ নেই, ছায়াটি তাকে শব্দহীন ভাষায় ডাকে। তারপর তার ঘুম ভেঙে গেলে নিছক কল্পনা বা হ্যালুসিনেশন বলে ঘটনাটি তিনি ভুলে যান। তিন সপ্তাহ পর, ড. রুমানা পাণ্ডুলিপির একটি অংশ অনুবাদ করতে সক্ষম হন। তাও নিজের অজান্তে। সেখানে লেখা—‘তারা, যারা নক্ষত্রের মাঝখানে ঘুমায়, তাদের ডেকো না। যাদের চিন্তা রেখার বাইরে, তাদের ভাষা বুঝবে না, তবু উচ্চারণ করবে। উচ্চারণই তোমার সীমার অবসান। ঘুমন্ত ছায়া কৃত্তিকার নিঃশ্বাস জাগবে, যেদিন সত্তাভোজী স্পর্শ করবে নিষিদ্ধ বৃত্ত।’ তিনি কৌতূহল সামলাতে না পেরে উচ্চারণ করেন সম্পূর্ণ বাক্যটি। প্রতিদিনই তিনি একটা একটা করে নতুন বাক্য অনুবাদ করতে থাকেন। তারপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। লাইব্রেরিতে বিভিন্ন বইয়ের অক্ষর নিজে নিজে বদলায়। ছাত্রছাত্রীরা কিছু স্বপ্ন দেখে—আকাশ ফেটে যাচ্ছে, গাছগুলো ফিসফিস করে কিছু বলছে এবং কেউ তাদের চিন্তা বা আত্মা ‘চুরি করে’ নিচ্ছে। কিন্তু একজন গবেষক, সাঈদ, লক্ষ্য করেন—যে রাতে পাণ্ডুলিপির উচ্চারণ করা হয়, সেদিন পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র সাময়িকভাবে বিকৃত হয়। ড. রুমানা একরাতে নিজের কক্ষ থেকে নিখোঁজ হন। শুধু একটি ভিডিও বার্তা পাওয়া যায়, যেখানে তিনি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কিছু উদ্ভট কথাবার্তা বলেন। তিনি ধীরে ধীরে বলেন, ‘এ ভাষা আমাদের তৈরি করেনি। আমরা কেবল শব্দের ছায়া। যখন উচ্চারণ করি, ওরা আমাদের শোনে। ওরা এখন আসছে।’ সেই রাতের পর, পাণ্ডুলিপিটিও আর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ছোট এক বিভাগীয় জনপদ। নারায়ণ বিশ্বাসের গ্রামের বাড়ি এখানেই। তার বড় সাবেকি আমলের জমিদারবাড়িতে গড়ে তোলেন নিজের সংগ্রহশালা। কিন্তু তিনি বেশ কিছুদিন ধরে অবসাদগ্রস্ত। কিছুতে মন বসাতে পারছেন না। না নিজের পেশায়, না শখের কাজে। সবকিছু চলছিল স্বাভাবিক, যতদিন না একদিন আকাশে দেখা গেল এক অচলনশীল কালো ছায়া। ছায়াটি কোনো মেঘ নয়। এটি জায়গা বদলায় না, তবে দিনে দিনে আস্তে আস্তে আকারে বড় হতে থাকে। সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছায় না, রাতেও তারার দেখা মেলে না। দিনের মধ্যে একসময় পুরো গ্রামের ওপর ছায়া নেমে আসে—চুপচাপ, ঠান্ডা আর অস্বাভাবিক নীরবতা নিয়ে। প্রথম কিছুদিন কেউ বিষয়টি আমলে নেয় না। মনে করেছিল হয়তো কোনো জলবায়ুগত পরিবর্তন। তবে এরপর আস্তে আস্তে গ্রামে শুরু হয় ভয়ংকর স্মৃতিলোপ। প্রথমে একজন বৃদ্ধ ভুলে যান নিজের ছেলেমেয়েকে। তারপর একে একে অনেকেই সব ভুলে যেতে থাকে। স্কুলশিক্ষক ভুলে যান বর্ণমালা। এক বৃদ্ধা নিজের নাম বলতে পারেন না। মানুষ তাদের পরিচয়, স্মৃতি, আত্মচেতনা হারাতে শুরু করে এবং কদিন পর দেখা যায় তারা কথা বলতেও ভুলে গিয়েছে। মাতৃভাষা তো কেউ কখনোই ভুলে না। ডাক্তার ও গবেষক দল পাঠানো হয় বিষয়টি তদন্ত করার জন্য, কিন্তু তারাও ফিরে আসে না। তারাও ভুলে যায় সবকিছু। মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক তানভীর হাসান, যার ভাই ছিলেন গ্রামের স্কুলশিক্ষক। তার কথাতেই তিনি এখানে এসেছিলেন। এসে দেখলেন তার ভাইও সব ভুলে গিয়েছেন। তিনি আবিষ্কার করেন, ছায়ার নিচে থাকা মানুষদের চোখে কোনো আলোর প্রতিফলন নেই, যেন তারা আস্তে আস্তে মানবসত্তা হারিয়ে শূন্য পাত্রে পরিণত হচ্ছে। একদিন রাতে তানভীর আকাশের ছায়ার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। পরদিন সকালে তিনি নিজের নাম ভুলে যান। হাতে থাকে তার নিজের হাতে লেখা একটি চিরকুট, ‘ছায়াটি সত্তাভোজী। এটি কোনো বস্তু নয়, এটি একটি অস্তিত্ব। ছায়াটির আকৃতি নেই। ছায়াটি পর্যবেক্ষণ করলে একটা পালসার বলে ভ্রম হয়। আমরা আস্তে আস্তে ছায়ায় রূপ নিচ্ছি।’ খবরটি বাইরের কেউও জানতে পারে না। সরকার চাপের মুখে পড়বে বলে ওই অঞ্চলের সবার স্মৃতিলোপের বিষয়টি গোপনে চেপে যায়। একই দেশে থেকেও সবারই অজানা ঘটনাগুলো। নির্মাল্য দত্ত একজন প্রথিতযশা স্থপতি। জন্মের পর থেকেই আমেরিকা চলে যান মায়ের সঙ্গে। পড়াশোনা, বিয়ে সবকিছুই সেখানে। আমেরিকায় এখন তিনি বড় বড় প্রজেক্টের নকশা করেন। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি বাংলাদেশে নিজের পৈতৃক সম্পদ সংস্কারকাজ করে আমেরিকায় ফিরে আসেন। স্ত্রীর শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ায় তিনি আমেরিকা চলে আসেন। আসার পর থেকে নির্মাল্য প্রতি রাতে এক অদ্ভুত শহরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। স্বপ্নে তিনি একটি শহর দেখেন। সেই শহরে নীল আকাশ নেই—শুধু আলোহীন ধূসর আকাশগাত্র। রাস্তাগুলো অসম্ভব দীর্ঘ, যেন শেষ হয় না এবং প্রতিটি ভবন বিকৃত জ্যামিতির, যেন মেপে নয়, জেগে ওঠে গড়ে উঠেছে। কোথাও কোনো মানুষ নেই, কেবল ছায়ামতো কিছু নড়াচড়া করে। সব জিনিস আকাশগাত্রে ভাসছে। সমুদ্রের পানি আকাশে। শহরের অট্টালিকাগুলো পতঙ্গের মতো উড়ছে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এটি মানসিক চাপের ফল। কিন্তু ধীরে ধীরে অদ্ভুত মিল খুঁজে পান। ঢাকার এক মনোচিকিৎসক বন্ধুকে যখন বিষয়টি বলেন, বন্ধু বিস্ময়ে জানায়—একাধিক রোগীও একই স্বপ্ন দেখছে। প্রথম রাতে তিনি যে স্বপ্নটি দেখেন, তা ছিল অস্পষ্ট। একটি শহর—আলোহীন, নির্জন, কুয়াশায় মোড়া। শহরের রাস্তাগুলো সোজা নয়, যেন ইচ্ছেমতো গড়ানো। ভবনগুলোর আকার ছিল বিকৃত—দেয়াল যেন বাঁকানো, জানালা গলিয়ে নিচে নামা, দরজাগুলো অদ্ভুতভাবে নিচু বা বেশি উঁচু। দ্বিতীয় রাতে তিনি ফের সেই শহরেই ফিরে যান। এবার তিনি কিছুটা পথ হাঁটেন। কিছু ভবনের গায়ে অচেনা প্রতীক আঁকা, চোখ-কান-মুখ ছাড়া মুখাবয়ব। কিন্তু আশ্চর্যভাবে, সেই প্রতীকগুলোর দিকে তাকালে তার মনে হয় সে এগুলো চেনে, অনেক আগে কোথাও দেখেছে। এই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি বাড়তে থাকে। প্রতিটি রাতেই নির্মাল্য সেই শহরে পৌঁছায়, প্রতিবারেই শহর তার কাছে একটু বেশি খুলে পড়ে। প্রতিবারেই কোনো এক অদৃশ্য সত্তা তাকে থামিয়ে দেয়—কখনো ঘড়ির কাঁটার মতো শব্দে, কখনো বাতাসে অদৃশ্য চাপের ভেতর। এরপর বাস্তবেও পরিবর্তন দেখা দেয়। নির্মাল্য আঁকা শুরু করেন। কাগজে, দেয়ালে, কাঠে। কিন্তু তার আঁকা স্থাপনাগুলো কারও চোখে সহ্য হয় না। যেন মানুষের অস্তিত্বই এ শহরের বিরোধিতা। তার স্ত্রী-সন্তানরাও নাকি একই স্বপ্ন দেখছে। তারপর অফিসের সব সহকর্মীর মুখেও শুনেছেন একই ঘটনা। তারপর একদিন টিভিতে আস্তে আস্তে বড় বড় সব নিউজে সবার একই স্বপ্ন দেখার নিউজ আসতে শুরু করে। দিন দিন মহামারিতে রূপ নিচ্ছে ঘটনাগুলো। তার বাবার কিছু পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় তার। তাহলে কি পুরো পৃথিবী আবার ধ্বংস হবে? মানবজাতি ধ্বংস হবে? তার বাড়ি থেকে প্রপাত সেই মূর্তি আর পাণ্ডুলিপির ঘটনা কি তবে সত্য? নির্মাল্য তো ভেবেছিলেন সব তার বাবার প্রলাপ। তারপর এক সন্ধ্যায়, নির্মাল্য আয়নায় নিজেকে দেখতে গিয়ে একমুহূর্তের জন্য চমকে ওঠেন। তার চোখের মণি যেন কাঁপছে—বৃত্ত নয়, সর্পিল রেখার মতো ঘুরছে। তিনি বুঝতে পারেন—স্বপ্ন তাকে বদলে দিচ্ছে। একদিন বিকেলে, হঠাৎ তারই টেবিলে দেখতে পান সেই পাণ্ডুলিপিটি। পুরোনো পাণ্ডুলিপির ভাঁজে খুঁজে পায় একটি বাক্য—‘এই শহর স্বপ্নে জন্মায়, স্মৃতিতে বাঁচে আর বাস্তবকে খেয়ে ফেলে। আবার জন্মায় আবার তৈরি হয় তাদের অনুকূলে।’ সেই রাতেই নির্মাল্য আবার স্বপ্ন দেখেন। চারদিকে ঘুরতে থাকা শত শত ছায়া—মানুষের মতো, কিন্তু মূক, দৃষ্টিশূন্য। একটি ছায়া এগিয়ে এসে তার কানে ফিসফিস করে, ‘তুই এখন এখানকার। বাইরে যা ছিলি, তা ভুলে যা। এই শহর আমাদের নয়, তোর স্মৃতির গহ্বর থেকে উঠে এসেছে।’ আকাশে তাকান নির্মাল্য। খুব বৃহৎ কিছু এসে পড়েছে পৃথিবীর কাছে। তীব্র আলো আর কান ফাটানো শব্দে নির্মাল্য বুঝতে পারেন তিনি আর স্বপ্ন দেখছেন না। আকাশে যে বড় ছায়াটা দেখা যাছে, সেটা একটা প্রকাণ্ড নিউট্রন তারকা বা পালসার। আর পালসারটা জীবন্ত। এবার তার স্বপ্নে দেখা সব সত্য হয়ে যাচ্ছে। শহরের অট্টালিকাগুলো পতঙ্গের মতো উড়ছে। পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। মানুষের দেহ কাচের মতো ভেঙে ভেঙে টুকরো হচ্ছে, তারপর ধূলিকণার মতো উবে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানি আর দূরের ছোট ছোট পাহাড় সব আকাশে ভাসছে। নির্মাল্য আজকে তার বাবার কথা ভাবছেন। তিনি সত্যই বলেছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলো আজকে মিলে যাচ্ছে। তাহলে তার বাবার কথামতো তো শেষ নয় তবে, সবেমাত্র শুরু। আমরা আবার স্মৃতির বিনিময়ে ফেরত আসব! তিনিও এখন কাচের মতো ভেঙে যাচ্ছেন, কিছুক্ষণ পর ধুলোর মতো উবে যাবেন মহাকাশের নির্দয় কালো হাতে। কৃত্তিকা আবার তাদের আগের অবস্থায় নিয়ে যাবে। মহাকাশের অন্য কোনো স্থানে। অন্য কোনো নক্ষত্রের পাশে। যেভাবে সব ভেঙেছে, সেভাবেই সব গড়বে।
ঘুমিয়ে থাকা ঈশ্বর
একাকিত্বের মায়াজাল
“বাংলা কাব্যজগতে জীবনানন্দ দাশ কেবল বিষণ্নতারই কবি নন, একাকিত্বেরও কবি। তাঁর ‘পেঁচা’ কবিতায় রাতভর একা জেগে থাকে যে নিশিপাখি, সে নির্জন-নিস্তব্ধতার মহারহস্য জানে। মানুষের জানার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ জানেন তাঁর অনুভবের ‘জীবনদেবতা’র মহারহস্য। একা থাকার এ-রহস্য কেবল ভাববাদী দর্শনের বিষয় নয়, বস্তুবাদী দর্শনেও অন্য অর্থ জেগে ওঠে। এ-কথা দাবি করা চলে যে—একা, একাকী, একাকিত্ব মানবজীবনের এক অলঙ্ঘনীয় অভিশাপ। এমন কোনো মানুষ নেই যিনি কোনো না কোনো সময় এর রহস্যময়তায় আটকে পড়েননি। কেননা ‘দুঃখ’ এই একাকিত্বের যমজভাই। দুঃখ হচ্ছে মহাসত্য, একাকিত্বও তাই। একাকিত্ব থেকে আত্মরক্ষার একটাই পথ—বিচ্ছিন্নতার বদলে মানুষকে, সমাজকে আঁকড়ে ধরা। যতই দুঃখ আসুক মানুষের কোলাহলের দিকে ছুটে যাওয়া, মানুষের ভেতর আশ্রয় নেওয়াই সত্য। মানুষই মানুষের শান্তির ঠিকানা, অন্য কোনো কল্পিত ঠিকানা নয়।”
একাকিত্বের মায়াজাল