বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২

তুচ্ছ ঘটনায় এভাবেও তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়?

নূরে আলম সিদ্দিকী
প্রকাশ : ০৩ জুলাই ২০২৫, ০৮:০৩ পিএম
কুমিল্লার মুরাদনরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড়। ছবি : কালবেলা
কুমিল্লার মুরাদনরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতার ভিড়। ছবি : কালবেলা

কুমিল্লার মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনা শুধু মর্মান্তিক নয়, এটি আমাদের নৈতিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। এলাকাবাসীর কয়েকজনের ভাষ্যমতে, মোবাইল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই এটি সংঘটিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকাল ৯টায় দিকে উপজেলার বাঙ্গরা থানার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি প্রতিপক্ষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল। অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন, পরিবারটি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। এলাকায় ছিল তাদের অনেক প্রভাব। সেই ক্ষোভ ও সম্প্রতি মোবাইল চুরির ঘটনা দুইয়ে মিলে এ হত্যাকাণ্ড বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে প্রশ্ন ওঠে—একটি মোবাইল ফোনের মূল্য কি মানুষের জীবনের থেকে বেশি?

জমি নিয়ে দ্বন্দ্ব, খেলা নিয়ে দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বসহ নানা তুচ্ছ ঘটনায় ঝরে যাচ্ছে একের পর এক প্রাণ। যেটা নিয়ে দ্বন্দ্ব সেগুলো ফেরত এলেও ঝরে যাওয়া জীবন আর কখনোই ফেরত আসে না। ভুক্তভোগী পরিবার বয়ে বেড়ায় দুঃসহ স্মৃতি।

ঘটনার পর অভিযুক্তরা আটক হন, মামলা ও বিচারের সম্মুখীনও হন; কিন্তু তাতেই থেমে থাকে না এসব অপরাধ। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে এসব ঘটনা। আমরা কখনোই ভাবি না মুরাদনগরে হত্যাকাণ্ডের শিকার রাসেলের দুই বছর বয়সী বাচ্চার মতো এমন অসংখ্য বাচ্চাকে তুচ্ছ ঘটনায় এতিম করে দিচ্ছি।

এসব ঘটনা আমাদের আইনশৃঙ্খলার দিকেই তীর ছোড়ে না, আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্রও তুলে ধরে। যখন একটি সম্প্রদায় নিজের হাতে বিচার করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তা শুধু আইনের শাসনের প্রতি অবমাননাই নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনও।

এ ধরনের ঘটনায় কেবল আইনি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে যে, পিটিয়ে মেরে ফেলা কোনো সমাধান নয়। এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া দরকার যে, প্রত্যেক মানুষের জীবনের মূল্য অপরিসীম এবং সামান্য ঘটনায় হত্যার মাধ্যমে এর বিচার সম্ভব নয়।

মুরাদনগরের এ ঘটনা আমাদের সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা হিংস্রতা এবং অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন। আমাদের প্রয়োজন এমন একটি সমাজ, যেখানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি বিরাজ করবে এবং কোনো তুচ্ছ ঘটনা কারও জীবন কেড়ে নেবে না।

যদিও মুরাদনগরের এ ঘটনার তদন্ত এখনো চলমান। এ ঘটনায় এখনো কোনো দোষীকে আটক বা গ্রেপ্তার করা যায়নি। যদি প্রমাণ হয়েই থাকে ওই পরিবার দোষী, তাহলে তাদের আইনের মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া যেত। যদি আইন নিজেরাই নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া হয় তবে এই নৈতিক অবক্ষয় আরও বাড়তে থাকবে। সমাজের স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা থমকে যাবে।

তুচ্ছ ঘটনায় হত্যার মতো ঘটনা শুধু একটি সমস্যা নয়, এটি আমাদের সমাজের গভীরতর সংকটের প্রতিফলন। এর সমাধানে শিক্ষা, আইন, এবং সামাজিক সংস্কারের পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তির সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

আজ পবিত্র মুহররম ও আশুরা, মর্যাদা ও তাৎপর্য 
আজ ১০ মহররম। বিশ্বজুড়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও শোকাবহ এক দিন আজ। হিজরি সনের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরা হিসেবেও পরিচিত। আরবি ‘আশারা’ শব্দের অর্থ দশ। আর আশুরা মানে দশম। আর মহররম অর্থ সম্মানিত। হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এবং তার পরিবারের সদস্যরা কারবালার ময়দানে ইয়াজিদের সৈন্যদের হাতে শহীদ হন। কোররআন মজিদে ও হাদিস শরিফে এ মাস সম্পর্কে যা এসেছে তা হলো, এটা অত্যন্ত  ফজিলতপূর্ণ মাস। কোরআনে বর্ণিত ৪টি সম্মানিত মাসের প্রথম মাস মহররম, যাকে আরবের অন্ধকার যুগেও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হতো। শরিয়তের দৃষ্টিতে যেমন এ মাসটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। হাদিসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলে অভিহিত করা হয়েছে। এই মাসে সংঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ অনেক দীর্ঘ।  আমরা দেখতে পাই, ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী এই মহররম মাস। ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয় এ মাসে। শুধু উম্মতে মুহাম্মদীই নয়, বরং পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবীদের অবিস্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল এই মাসে। কুরআনের ভাষায় এটি ‘আরবাআতুন হুরুম’-অর্থাৎ চার সম্মানিত মাসের অন্যতম। আবহমানকাল থেকে আশুরার দিনে সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আশুরার দিন কারবালার ময়দানে সংঘটিত দুঃখজনক ঘটনাও মুসলিম জাতির জন্য অতিশয় হৃদয়বিদারক ও বেদনাদায়ক। প্রতিবছর আশুরা আমাদের এই দুঃখজনক ঘটনাকেও স্মরণ করিয়ে দেয়। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে হজরত ইমাম হোসেন (রা.)-র আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা জোগায়।  পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে-অর্থাৎ নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস, আল্লাহর কিতাবে (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজদের উপর কোন যুলম করো না, আর তোমরা সকলে মুশরিকদের সাথে লড়াই কর যেমনিভাবে তারা সকলে তোমাদের সাথে লড়াই করে, আর জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে আছেন।(সুরা তাওবা-৩৬) এ মাসে রোজা রাখার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রমযানের পর আল্লাহর মাস মুহাররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ।’-সহীহ মুসলিম ২/৩৬৮; জামে তিরমিযী ১/১৫৭। এর মধ্যে আশুরার রোজার ফজিলত আরও বেশি। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমজান ও আশুরায় যেরূপ গুরুত্বের সঙ্গে রোজা রাখতে দেখেছি অন্য সময় তা দেখিনি।’ -সহীহ বুখারী ১/২১৮। হাদিস রয়েছে। যেমন -অর্থাৎ-আবু বকরাহ (রা.) হতে বর্ণিত যে, নাবী (সা.) বলেছেন- আল্লাহ্ আসমান ও জমিনকে যেদিন সৃষ্টি করেছিলেন, সেদিনের অবস্থায় জামানা আবার ফিরে এসেছে। বার মাসে এক বছর হয়। তার মধ্যে চারটি মাস মর্যাদাসম্পন্ন। যুলকাদা, যুলহাজ্জা ও মুহাররম এ তিন মাস এক নাগাড়ে আসে। আর মুযার গোত্রের রজব মাস যা জুমাদা ও শা’বান মাসের মধ্যে। (সহীহ বুখারি (তাওহিদ), হাদিস নম্বর : ৭৪৪৭। হজরত আলিকে (রা.) এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছিল, রমজানের পর আর কোনো মাস আছে, যাতে আপনি আমাকে রোজা রাখার আদেশ করেন? তিনি বললেন, এই প্রশ্ন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জনৈক সাহাবি করেছিলেন, তখন আমি তার খেদমতে উপসিত ছিলাম। উত্তরে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘রমজানের পর যদি তুমি রোজা রাখতে চাও, তবে মুহররম মাসে রাখ। কারণ, এটি আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একটি দিন আছে, যে দিনে আল্লাহ তাআলা একটি জাতির তওবা কবুল করেছেন এবং ভবিষ্যতেও অন্যান্য জাতির তওবা কবুল করবেন।’-জামে তিরমিজি ১/১৫৭। অন্য হাদিসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোজার কারণে আল্লাহ তায়ালা অতীতের এক বছরের (সগিরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ -সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামে তিরমিজি ১/১৫৮। আশুরার রোজা সম্পর্কে এক হাদিসে আছে যে, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো এবং ইহুদিদের সাদৃশ্য পরিত্যাগ করে; আশুরার আগে বা পরে আরো একদিন রোজা রাখো।’ -মুসনাদে আহমদ ১/২৪১। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখেও অবশ্যই রোজা রাখব।’-সহীহ মুসলিম ১/৩৫৯। এ মাসে পৃথিবীর বহু ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এদিনে আল্লাহতায়ালা তার কুদরত প্রকাশ করেছেন। বনি ইসরায়েলের জন্য সমুদ্রে রাস্তা বের করে দিয়েছেন এবং তাদেরকে নিরাপদে পার করে দিয়েছেন। আর একই রাস্তা দিয়ে ফেরাউন ও তার অনুসারীদেরকে ডুবিয়ে মেরেছেন।-সহীহ বুখারী ১/৪৮১। তবে এ দিনের গুরুত্ব প্রকাশ করতে গিয়ে অনেকে নানা ভিত্তিহীন কথাও বলে থাকেন। যেমন, এদিন হজরত ইউসুফ আ. জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হজরত ইয়াকুব আ. চোখের জ্যোতি ফিরে পেয়েছেন। হজরত ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছেন। হজরত ইদরিস আ.কে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। অনেকে বলে, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই।-আল আসারুল মারফুআ, আবদুল হাই লাখনেবী ৬৪-১০০; মা ছাবাহা বিসসুন্নাহ ফী আয়্যামিস সানাহ ২৫৩-২৫৭। এ মাসের একটি ঘটনা শাহাদাতে হুসাইন রা.। বলাবাহুল্য যে, উম্মতের জন্য এই শোক সহজ নয়। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই তো শিক্ষা-‘নিশ্চয়ই চোখ অশ্রুসজল হয়, হৃদয় ব্যথিত হয়, তবে আমরা মুখে এমন কিছু উচ্চারণ করি না যা আমাদের রবের কাছে অপছন্দনীয়। অন্য হাদিসে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই যারা মুখ চাপরায়, কাপড় ছিড়ে এবং জাহেলি যুগের কথাবার্তা বলে। এ মাসে যেসব অনৈসলামিক কাজকর্ম ঘটতে দেখা যায় তার মধ্যে তাজিয়া, শোকগাঁথা পাঠ, শোক পালন, মিছিল ও র‌্যালি বের করা, শোক প্রকাশার্থে শরীরকে রক্তাক্ত করা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এসব রসম-রেওয়াজের কারণে এ মাসটিকেই অশুভ মাস মনে করার একটা প্রবণতা অনেক মুসলমানের মধ্যেও লক্ষ করা যায়। এজন্য অনেকে এ মাসে বিয়ে-শাদি থেকেও বিরত থাকে। বলাবাহুল্য এগুলো অনৈসলামিক ধারণা ও কুসংস্কার।  ইমাম হুসাইন (রা.) এর জন্য শোক প্রকাশ করতে গিয়ে শিয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা যা করেন যেমন-মাতম করা, উচ্চস্বরে আহাজারি করা, বুক চাপরানো, পোশাক ছিড়ে ফেলা, শরীর রক্তাক্ত করা এ সমস্ত কাজগুলো ইসলাম সম্মত নয়। প্রকৃত সত্য হলো এগুলো জাহেলি যুগের আচরণ। এ সমস্ত কাজ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে। হযরত ‘আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন: যারা শোকে গন্ডে চপেটাঘাত করে, জামার বক্ষ ছিন্ন করে ও জাহিলি যুগের মত চিৎকার দেয়, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়। (সহিহ বুখারি (তাওহিদ), হাদিস নম্বর : ১২৯৭,আধুনিক প্রকাশনী : ১২১২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন : ১২১৯) হাদিসের মান. সহিহ)। অতএব শাহাদাতে হুসাইন রা.কে কেন্দ্র করে কোনো ধরনের অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হওয়া এবং সব ধরনের জাহেলি রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য। ইমাম হুসাইন (রা.) এর উচ্চ মর্যাদার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে কারো দ্বিমত নেই। তিনি জ্ঞানী সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অন্যতম। দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে তিনি মুসলিমদের নেতা। জান্নাতি যুবকদের নেতা। ইবাদত-বন্দেগি, সাহসিকতা-বীরত্ব, বদান্যতায় তিনি খ্যাত। সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের সর্বকনিষ্ঠা আদরের দুলালি মা ফাতেমা (রা.) এর সন্তান। তার মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনায় বিশ্বের সকল মুসলিম চরমভাবে ব্যথিত ও মর্মাহত। সাইয়েদুনা হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত ও এ জাতীয় মর্মান্তিক ঘটনা স্মরণের সময় আমাদের কর্তব্য হবে ধৈর্যধারণ করা, আল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। বান্দার জন্য যা কল্যাণকর আল্লাহ তা সংঘটিত করে থাকেন। যারা তার দ্বীনের জন্য কোরবানি পেশ করেন তাদের তিনি এর উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকেন। সার কথা : * আশুরা একটি গুরত্বপূর্ণ ইসলামি পর্ব। * আশুরাতে সওম পালন করা সুন্নাত। * আশুরার সওম দুদিন পালন করা উচিত। মুহাররম মাসের নবম ও দশম তারিখে। যদি নবম তারিখে সওম পালন সম্ভব না হয় তবে দশম ও একাদশ তারিখে সওম পালন করবে। মনে রাখতে হবে নবম ও দশম তারিখে দুটো সওম পালন করা উত্তম। * আশুরার জন্য শরিয়ত অনুমোদিত বিশেষ আমল হল এই সওম পালন। এ ছাড়া আশুরার অন্যকোনো আমল নেই। * কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার সাথে আশুরার কোন সম্পর্ক নেই। আশুরার মর্যাদা বৃদ্ধিতে বা কমাতে এর কোন ভূমিকা নেই। * কারবালার ইতিহাস স্মরণে আশুরা পালনের নামে যে সকল মাতম, মর্সিয়া,তাযিয়া মিছিল, শরীর রক্তাক্ত করাসহ যা কিছু করা হয় এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম এ সকল কার্য্যকলাপের অনুমোদন দেয় না। এগুলো সন্দেহাতীত ভাবে বিদআত। এগুলো পরিহার করে চলা ও অন্যদের পরিহার করতে উৎসাহিত করা রসুলে কারিম (সা.) সুন্নাহ অনুসারী সকল ঈমানদারের কর্তব্য।  মোটকথা, এ মাসের করণীয় বিষয়গুলো যখা, তওবা-  ইস্তেগফার, নফল রোজা এবং অন্যান্য নেক আমল। এসব বিষয়ে যত্মবান হওয়া এবং সব ধরনের কুসংস্কার ও গর্হিত রসম-রেওয়াজ থেকে বেঁচে কুরআন্তসুন্নাহ মোতাবেক চলাই মুসলমানের একান্ত কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন।  পরিশেষে মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে এই কামনা করি ‘আল্লাহ আপনি আমাদের প্রত্যেককে আপনার দেওয়া বিধি-বিধান সমূহ যথাযথ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুণ। আমিন।  লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
আজ পবিত্র মুহররম ও আশুরা, মর্যাদা ও তাৎপর্য 
সবুজ অর্থায়নের কৌশলগত বিশ্লেষণ / বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষ করে সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ প্রকল্পকে উৎসাহিত করতে নীতিমালা ও অর্থায়ন প্রকল্প চালু করেছে। তবে, নীতিগত অসামঞ্জস্যতা, আর্থিক প্রতিবন্ধকতা, দুর্বল অবকাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়হীনতা এই বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে বাধাগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় বিপুল বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বর্তমান পরিবেশ যথেষ্ট সহায়ক নয়। এই সমস্যা সমাধানে নীতিগত সংহতি ও স্থিতিশীলতা আনা প্রয়োজন। সবুজ অর্থায়ন বলতে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমকে উৎসাহিত করে এমন ঋণ বা বিনিয়োগকে বোঝায়, যার মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এবং সবুজ অবকাঠামো নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত। এটি কেবল পরিবেশ সুরক্ষায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধা প্রদান করে। বৈশ্বিক সবুজ অর্থায়ন বাজার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবুজ প্রকল্পের উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে সবুজ বন্ড, সবুজ ঋণ, সবুজ বন্ধকী, সবুজ ক্রেডিট কার্ড এবং টেকসই বিনিয়োগ তহবিল।  ২০০৯ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিতে ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা পূরণ হয়নি। সম্প্রতি, ২০২৫ সালের নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০শতাংশ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রয়োজন হবে, যা ২০৩১-২০৪০ সময়কালে বার্ষিক ১ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে। এই বিপুল তহবিলের জন্য বৃহৎ আকারের বেসরকারি বিনিয়োগ অপরিহার্য। ভিয়েতনাম, চীন, ভারত এবং মরক্কোর মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সফল মডেলগুলি সুসংগত নীতিগত প্রণোদনা, ঝুঁকি লাঘব এবং শক্তিশালী পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের গুরুত্ব তুলে ধরে। এই সব দেশের মডেলসমূহ হতে ধারণা নিয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে নিজস্ব স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারে।  বাংলাদেশ ব্যাংক সবুজ অর্থায়নকে উৎসাহিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে, যেখানে ২০১৬ সাল থেকে ব্যাংকগুলিকে তাদের মোট ঋণের ন্যূনতম ৫ শতাংশ সবুজ অর্থায়নে বরাদ্দ করতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এছাড়াও জিটিএফ (Green Transformation Fund) এর মতো পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে কম খরচে তহবিল সরবরাহ করা হয়। আইইইএফএ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই তহবিল ব্যবহারের হার কমই রয়ে গেছে (যেমন, জিটিএফ-এর জন্য ১৯ দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ)। এই প্রকল্পগুলির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সমন্বয় বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত নীতিগত অসংগতি এবং নিয়ন্ত্রক অনিশ্চয়তার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কুইক এনহ্যান্সমেন্ট অফ ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জি সাপ্লাই অ্যাক্ট (QEEESA) ২০১০ বাতিল এবং ৩০টিরও বেশি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প স্থগিত করা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন করেছে। মাতারবাড়িতে নতুন কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরুজ্জীবিত করার বিবেচনা জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক । ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য প্রণোদনার অভাবও একটি বড় সমস্যা। নীতিগত সংহতি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সৌরশক্তির সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ব্যবহার। বছরে ৩০০ দিনের বেশি রৌদ্রোজ্জ্বল দিন থাকায় সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ একটি আদর্শ স্থান। সবুজ অর্থায়নের আওতায় সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সোলার হোম সিস্টেম ও কৃষি সেচ ব্যবস্থায় সৌর পাম্প ব্যবহারের মতো সবুজ প্রকল্প (green project) গুলোয় বিনিয়োগে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে।  সবুজ ভবনের (green building) ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি বিরল অর্জন হলো ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের লিড গোল্ড সার্টিফিকেট অর্জন—যা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য, শক্তি দক্ষতা এবং জল ব্যবস্থাপনার মানদণ্ডে একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি। হাসপাতালটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে এটি আমার জন্য এক বিশেষ অর্জন। এই হাসপাতালটি শুধু চিকিৎসা সেবাতেই নয়, পরিবেশ সংরক্ষণেও অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হাসপাতাল চত্বরজুড়ে ছায়াঘেরা সবুজ গাছপালা, উদ্ভিদ-বেষ্টিত গার্ডেন এবং আলো-বাতাস প্রবাহের স্বাভাবিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।  বাংলাদেশ বৈশ্বিক কার্বন বাজার থেকে বছরে ১ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করার সম্ভাবনা রাখে, কিন্তু একটি স্পষ্ট জাতীয় নীতির অভাবে এই খাতের বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ২০০৬ সাল থেকে উন্নত রান্নার চুলা এবং সৌর হোম সিস্টেমের মতো কার্বন-হ্রাসকারী উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ১৭ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তবে, দুর্বল নীতি কাঠামো এবং বেসরকারি খাতের সীমিত অংশগ্রহণের কারণে দেশটি তার সম্ভাবনার খুব সামান্যই কাজে লাগাতে পারছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০২৫-এ নবায়নযোগ্য জ্বালানি সার্টিফিকেট (REC) প্রবর্তনের কথা বলা হয়েছে, যা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত প্রতি মেগাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুতের পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিধিত্ব করবে। তবে, বর্তমানে কার্বন ট্রেডিং থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ ভারতীয় পরামর্শকদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যা দেশীয় নিয়ন্ত্রণে আনার সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশমালাগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানি নিরাপত্তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকেও দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করবে। লেখক : ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল এন্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার এবং ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ল্যাবএইড গ্রুপ
বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের ঝুঁকি ও সুযোগ
শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা  ‘পলাশী দিবস’ ৩ জুলাই
নবাব সিরাজউদ্দৌলা পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হন। এরপর মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে পাটনা যাওয়ার পথে তাকে ধরে এনে ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই শহীদ করা হয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা তার ঘনিষ্ঠজনদের ষড়যন্ত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভের কাছে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন (সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার)। মীর জাফর আলী খান, রাজবল্লভ, শওকত জঙ্গদের বেঈমানির কারণে পশ্চিমবঙ্গের পলাশী প্রান্তরে নওয়াবের বাহিনীর পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ে মধ্যদিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর ভাগ্য বিপর্য্যয়ে হতভাগ্য ভারতবাসীর কপালে কলঙ্কের কালিমা লেপন হয়। বাংলাসহ ভারতে ঘটে ইংরেজ শক্তির অভ্যুদয়। সিরাজউদ্দৌলা নিহত হওয়ার পর ইংরেজরা বাংলার নওয়াবদের হাতের পুতুলে পরিণত করে এবং তারাই বাংলার শাসকে পরিণত হয়। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলেও ৩ জুলাই ছিল অবিভক্ত বাংলাদেশে একটি জাতীয় দিবস ছিল। নির্বিশেষে সব বাঙালি দিবসটি পালন করত। দিবসটি ছিল জাতীয় উদ্দীপনামূলক। ‘পলাশী দিবস’ রূপে দিবসটি পরিচিত ছিল। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে আজ থেকে ২৬৮ বছর আগে এই দিনে নির্মমভাবে বন্দিশালায় হত্যা করা হয়। সারা উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সূচনা হয়। কবি নজরুল দিবসটি স্মরণ করেই লিখেছিলেন- ‘কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,/ বাঙ্গালীর খুনে লাল হ’ল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!/ ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর/ উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’নজরুলের ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ শীর্ষক এই গান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ঘরে ঘরে গাওয়া হতো। এখন গাওয়া হয় না। এখনো শহীদ সিরাজউদ্দৌল্লা দিবস হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদসহ কয়েকটি জেলায় ৩ জুলাই পালিত হয়। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে যথেষ্ট প্রেরণা জুগিয়েছে এই দিবস। সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভ নবাবকে হত্যা করে বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনা করেন। তারপর দিল্লির মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে সারা উপমহাদেশে ইংরেজরা তাদের  আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।  নবাব সিরাজকে জাতীয় বীর হিসেবে প্রথম ঘোষণা করেন নেতাজি সুভাষ বসু। কলকাতা করপোরেশনের মেয়র থাকাকালে তিনি মুর্শিদাবাদে গিয়ে নবাবের সমাধিতে পুষ্পস্তবক রেখে ঘোষণা করেন, You are not a fallen king, you are our national hero (পতিত রাজা নন, আপনি আমাদের জাতীয় বীর)। কলকাতায় ইংরেজরা একটি রাস্তার নাম রেখেছিলেন ক্লাইভ স্ট্রিট। তা পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা স্ট্রিট। ঢাকা শহর ব্রিটিশ আমলে ছিল একটি জেলা শহর। এই শহরেও প্রতিষ্ঠা করা হয় সিরাজউদ্দৌল্লা পার্ক। সিরাজউদ্দৌল্লা পার্কেই পাকিস্তান হওয়ার পর   রাজনৈতিক সভা হতো। সভার আকার বর্ধিত হওয়ায় তারপর তা চলে আসে সদরঘাট সংলগ্ন ভিক্টোরিয়া পার্কে (বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক)। জনসমাগম যখন ভিক্টোরিয়া পার্কে ধরত না, সভাস্থল তখন চলে যায় পল্টন ময়দানে। সেখান থেকে চলে যায় পুরোনো রেসকোর্স বা শহিদ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ব্রিটিশ আমলে নবাবের চরিত্রে নানা মিথ্যা অপবাদ দিয়ে ব্রিটিশ শাসকেরা অনেক ইতিহাস লিখিয়েছিল। তার মধ্যে একটি ছিল, সিরাজ কলকাতা আক্রমণের পর ২০০ ইংরেজ সৈন্যকে বন্দি করে একটি গুহায় রেখে মৃত্যুবরণে বাধ্য করেছিলেন। সেই মৃত সৈন্যদের স্মরণে কলকাতায় একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছিল, যার নাম ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট। বিখ্যাত গবেষক ও ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় গবেষণা করে প্রমাণ করেন, হলওয়েল মনুমেন্টের কিস্সা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানানো। ইংরেজরা নবাবকে হেয় করার জন্য এই মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়েছিল। সুভাষ বসু ১৯৪১ সালে এই মনুমেন্ট ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। হলওয়েল মুভমেন্ট নামে খ্যাত তার এই আন্দোলন। তিনি মনুমেন্টে যান বিরাট মিছিল নিয়ে এবং ইংরেজ শাসকদের সামনে তা ভেঙে ফেলেন। তখনকার অনেক বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা তার এই মিছিলে যোগ দেন। তার বাবা শেখ লুতফুর রহমান চোখের অসুখের চিকিৎসার জন্য শেখ মুজিবকে  কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন। মাত্র দুজন মুসলমান ছাত্র মনুমেন্ট ভাঙার মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের একজন শেখ মুজিব। কয়েক জন বিখ্যাত ব্রিটিশ অধ্যাপক পরবর্তীকালে পর্য্যন্ত স্বীকার করেন, হলওয়েল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সম্পূর্ণ বানানো। প্রতিপক্ষকে  স্বৈরাচারী, বদমাশ, গুন্ডা, অত্যাচারী, হিসেবে চিত্রিত করে তাদের জাতির কাছেই হেয় করে রেখে নিজেদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্য পূরণ সাম্রাজ্যবাদীদের একটি পুরোনো কৌশল। এই যুগে ইরাকযুদ্ধের সময়ও প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের কাছে বিশ্বধ্বংসের মারণাস্ত্র আছে- এই মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে অন্যায় যুদ্ধে ইরাক দখল করে তাকে হত্যা করা হয়। করোনা ভাইরাসের হামলায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব যেমন বিপন্ন ছিল,  নবাবি আমলে তখন সুবে বাংলা (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) বিপন্ন  ভয়াবহ দস্যুদল বর্গি, হার্মাদ ও ওলন্দাজদের হামলায়। শয়ে শয়ে নরনারী হত্যা তারা করত। ফসল ও অন্যান্য সম্পদ লুট করত। দাসী হিসেবে বিক্রয়ের জন্য সুন্দরী নারীদের ধরে নিয়ে যেত। এদের ভয়ে তখন ছড়া তৈরি হয়েছিল, ‘ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে।’বর্গিদের নেতা  ছিল দস্যু ভার্গব । অসম্ভব নিষ্ঠুর চরিত্রের লোক। নবাব আলিবর্দীর পত্মী তার স্বামীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন বর্গিদের পরাজিত ও ভার্গবকে হত্যা করার জন্য। আলিবর্দী তা-ই করেছিলেন। তিনি সুবে বাংলাকে কার‌্যত স্বাধীন করেছিলেন দিল্লির অধীনতা অগ্রাজ্য করে । মুঙ্গের ও গঙ্গাতীরের যুদ্ধে হার্মাদ ও ওলন্দাজ দস্যুদের পরাজিত করে সিরাজউদ্দৌলা সুবে বাংলাকে তাদের নিয়মিত অত্যাচার ও লুণ্ঠন থেকে মুক্ত করেন। তিনি কলকাতা-যুদ্ধেও ক্লাইভকে পরাজিত করেন। ক্লাইভ প্রাণ বাঁচানোর জন্য মাদ্রাজে পলায়ন করেন। ইংরেজ সৈন্যরা পলাশীর যুদ্ধেও শুধু পরাজিত হওয়া নয়, নির্মূল হয়ে যেত,  মীরজাফর ও তার সহযোগী নব্য ব্যবসায়ী দল যদি নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বৃহস্পতিবার নবাবের পক্ষে অশ্বারোহীতে পদাতিক মিলে প্রায় অর্ধলক্ষ সেনা আর ৪০টি কামান এবং অভিজ্ঞ সেনানায়কবৃন্দ থাকার পরও প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলীর  ইশারায় সৈন্যরা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। আর এরফল দাঁড়ালো নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে গিয়ে বন্দী হন। পরবর্তীতে মীর জাফর আলীর পুত্র মীর মীরনের নির্দেশে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়। বাংলার স্বাধীনতার সূর‌্য অস্তমিত হবার দুইশত বছরের মাথায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এই বাংলা আবারো স্বাধীন হলো।  ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে তথাকথিত যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিরাজউদ্দৌলা শিশুকন্যা জোহরাকে নিয়ে গোপনে নৌকাযোগে মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। পথিমধ্যে রাতযাপনের জন্যে রাজমহলের এক মসজিদে আশ্রয় নিলে এর মোতাওয়াল্লি দানেশ ফকির বিশ্বাসঘাতকতা করে নবাবকে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেন। সিরাজকে গোসল করান হয় ভাগীরথী নদীর পানি দিয়ে। নবাব আলীবর্দী খাঁর সমাধিসৌধের বারান্দায় খোশবাগে  তাকে দাফন করেন। এ দেশের জনগণের ভাগ্যের বিপর‌্যয় সে থেকে ঘটে। আর ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনেরও অবসান হয়। সিরাজউদ্দৌলা আজও বেঁচে আছেন মানুষের হৃদয় জুড়ে দেশের জন্যে জীবন দিয়ে। ব্রিটিশরা নিষ্ঠুর শোষণ নিপীড়ন ও নির্মম গণহত্যার মাধ্যমে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। এ অপরাধের কোনো বিচার হয়নি বিশ্ব ইতিহাসে । এই বাংলা, বাংলাদেশ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে কখনো ভুলবে না। তার মৃত্যু দিবসে আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।   লেখক : ড. মো. আনোয়ার হোসেন, প্রেসিডেন্ট আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহল।
শহীদ নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা  ‘পলাশী দিবস’ ৩ জুলাই