বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩ ভাদ্র ১৪৩২

আধুনিক জীবনে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কৌশল

এম এম মাহবুব হাসান
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৯:৩৭ পিএম
এম এম মাহবুব হাসান। ছবি : সৌজন্যে
এম এম মাহবুব হাসান। ছবি : সৌজন্যে

মানুষ একটি সামাজিক জীব—এই বাক্যটি আমরা প্রায় সবাই শুনেছি। তবে এই কথাটির গভীরতা অনুধাবন করা সহজ নয়। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখা। মানুষের সমাজে সম্পর্ক ছাড়া যেমন বাঁচা যায় না, তেমনি সম্পর্ক নিয়েও সব সময় শান্তিতে থাকা সহজ নয়। এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতার মধ্যেই প্রতিনিয়ত গড়ে ওঠে, গুঁড়িয়ে যায় কিংবা টিকে থাকে আমাদের পরিবার, বন্ধুত্ব ও পেশাগত সংযোগগুলো।

আধুনিক জীবনে সম্পর্কের ধরন বদলেছে। আগে সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ত্যাগ, দায়িত্ব ও আন্তরিকতা—আজ সেখানে স্বার্থ, প্রতিযোগিতা, হিংসা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা প্রবলভাবে কাজ করে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভালো সম্পর্ক আর সম্ভব নয়। বরং বর্তমান বাস্তবতায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন নতুন কিছু কৌশল, মানসিক পরিণতিবোধ এবং সচেতন প্রয়াস।

এই প্রবন্ধে আমরা সেই বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং সম্পর্ক রক্ষার জন্য বাস্তবসম্মত কৌশলগুলো নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব।

সম্পর্কের বাস্তবতা: স্বার্থ ও সংবেদনশীলতার সংঘাত

সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন—“প্রত্যেক সম্পর্কের গভীরে একধরনের স্বার্থ কাজ করে।” এই ‘স্বার্থ’ শব্দটি অনেকেই নেতিবাচকভাবে দেখেন, তবে এর তাৎপর্য সব সময় নেতিবাচক নয়। মানুষ নিরাপত্তা, ভালোবাসা, সহানুভূতি, গ্রহণযোগ্যতা, সামাজিক মর্যাদা কিংবা মানসিক প্রশান্তির আশায় সম্পর্ক গড়ে তোলে। এগুলোও এক ধরনের কোমল ও মানবিক স্বার্থ।

কিন্তু যখন এই স্বার্থ একতরফা হয়ে যায় বা পারস্পরিক সম্মানবোধ হারিয়ে ফেলে, তখনই সম্পর্ক জটিল হয়ে পড়ে। তখন তা হয়ে দাঁড়ায় প্রতিযোগিতা, ঈর্ষা কিংবা নিয়ন্ত্রণের এক যুদ্ধক্ষেত্র।

উদাহরণস্বরূপ, পরিবারের ভিতরে ভাইবোনের মধ্যে সম্পত্তি কিংবা পরিবারের দায়িত্ববণ্টন নিয়ে বিভেদ দেখা যায়। বন্ধুদের মধ্যে একজনের সাফল্য অন্যজনের মনে হীনম্মন্যতা বা ঈর্ষার জন্ম দেয়। কর্মক্ষেত্রে একজনের পদোন্নতি অন্যজনের মনে অন্যায়বোধ তৈরি করে—যা দীর্ঘদিনের সুসম্পর্ককেও দূরে ঠেলে দিতে পারে।

সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জসমূহ

১. অতিরিক্ত প্রত্যাশা ও নিরাশা

আমরা অনেক সময় নিকটজনদের প্রতি এমন সব প্রত্যাশা পোষণ করি, যা হয়তো তারা পূরণ করতে সক্ষম নয় কিংবা তাদের পক্ষে বাস্তবসম্মত নয়। যেমন—আমরা চাই, কাছের মানুষটি সব সময় আমাদের মনের কথা বুঝবে, সঠিক সময়ে পাশে থাকবে কিংবা আমাদের মতো ভাববে। কিন্তু তা না হলে আমরা হতাশ হয়ে যাই, রাগ করি বা অভিযোগে মন ভরে যায়। এই হতাশা ধীরে ধীরে সম্পর্ককে ভাঙনের দিকে ঠেলে দেয়।

২. নিজস্বতা না বোঝা ও না মানা

প্রত্যেক মানুষের চিন্তা, পছন্দ, জীবনদর্শন, অনুভূতির গভীরতা আলাদা। কিন্তু আমরা প্রায়ই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। এর ফলে সম্পর্ক হয়ে পড়ে একমুখী ও চাপসৃষ্টিকারী। মানুষ তখন নিজের নিরাপত্তার জন্য দূরত্ব তৈরি করে।

৩. যোগাযোগের অভাব

অসংলগ্ন যোগাযোগ, দীর্ঘ সময় যোগাযোগহীনতা, কিংবা মনের কথা খোলাখুলি না বলার অভ্যাস—সবকিছু মিলে অনেক সম্পর্কেই দূরত্ব তৈরি হয়। ভুল বোঝাবুঝি বাড়ে। আধুনিক জীবনে প্রযুক্তির সঙ্গে যে মানুষ যত বেশি যুক্ত, বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলো থেকে সে ততই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

৪. অহংবোধ ও ক্ষমা না করার মানসিকতা

ক্ষমা চাইতে বা ক্ষমা করতে পারা একটি সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি। কিন্তু অনেকে এই সহজ কাজটিই করতে পারেন না, কারণ তারা মনে করেন ক্ষমা করলে নিজেকে ছোট প্রমাণ করতে হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন—‘আমি কেন প্রথমে ক্ষমা চাইব?’ এই অহংবোধের কারণে অনেক ভালো সম্পর্কেও ফাটল ধরে। ধীরে ধীরে সেই ফাটল দূরত্বে রূপ নেয়, যা আর সহজে জোড়া লাগে না।

সম্পর্ক রক্ষার কিছু বাস্তব কৌশল

১. আত্মজ্ঞান ও সংবেদনশীলতা বাড়ানো

সুসম্পর্কের মূল ভিত্তি হলো নিজেকে জানা ও অন্যের অবস্থান বুঝতে শেখা। নিজের আবেগ, রাগ বা হতাশা কীভাবে সম্পর্ককে প্রভাবিত করে, তা বুঝতে না পারলে আমরা সম্পর্কের ক্ষতি নিজের হাতেই করে ফেলি। সংবেদনশীলতা মানে নিজে কষ্ট পেয়ে কাঁদা নয়, বরং অন্যের কষ্ট অনুভব করতে পারার ক্ষমতা অর্জন।

২. খোলামেলা ও সম্মানজনক যোগাযোগ

কিছু একটা বলা দরকার, তবে কীভাবে এবং কখন বলা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সম্পর্কের যত ঝামেলা, অধিকাংশই মিটে যেতে পারে যদি উভয়পক্ষ খোলামেলা, আন্তরিক এবং সম্মানজনকভাবে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। এটি একটি নিয়মিত অভ্যাস হিসেবে গড়ে তুললে অনেক দূরত্বই কমে আসে।

৩. প্রশংসা ও স্বীকৃতি প্রদান

কোনো মানুষই চায় না তার চেষ্টা, কষ্ট বা সাফল্য অবমূল্যায়ন করা হোক। যদি আপনি চান কেউ আপনাকে সম্মান করুক, তাহলে প্রথমেই তাকেই সম্মান দিন। একজন সহকর্মীর সাফল্য দেখে ঈর্ষা না করে তাকে সাধুবাদ বা অনুপ্রেরণা দিন—এতে সম্পর্কও টিকে থাকবে এবং আপনার নিজের মনও হবে উদার ও প্রসারিত।

৪. ব্যক্তিগত সীমা মেনে চলা

প্রতিটি মানুষ একটি ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার রাখে—যাকে ইংরেজিতে বলা হয় “personal boundaries”। এটি হতে পারে তার একান্ত সময়, মানসিক অবস্থা, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীলতা। সেই সীমারেখা অতিক্রম করলে তার অনুভূতিতে আঘাত লাগে, যা পরবর্তী সময়ে সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে।

৫. হিংসা নয়, প্রেরণা নেওয়া

পরিচিত কারও অগ্রগতি বা সাফল্যে ঈর্ষা অনুভব হলে নিজেকে প্রশ্ন করুন—“সে কীভাবে এটা করল?” এবং “আমি কীভাবে নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পারি?” এভাবে হিংসার জায়গা দখল করে নেয় শেখার মনোভাব, যা সম্পর্ককে বিষাক্ত না করে বরং আরো পুষ্টি জোগায়।

৬. দ্বন্দ্বে পরিপক্বতা দেখানো

সম্পর্কে দ্বন্দ্ব থাকবেই—তবে সেটা কীভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে সেটাই মুখ্য। আবেগে বিস্ফোরণ ঘটানো নয়, বরং যুক্তিভিত্তিক সমাধান খোঁজা উচিত। অনেক সময় একটু নীরবতা, একটু সময়, বা স্থানচ্যুতি—এই ছোট ছোট পন্থাই সম্পর্ককে ভেঙে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে।

৭. মানসিক সুস্থতায় যত্নশীল থাকা

একজন মানসিকভাবে অস্থির মানুষ কোনো সম্পর্কেই সুস্থ থাকতে পারেন না। তাই নিজের ভেতরের ক্লান্তি, উদ্বেগ ও হতাশাকে চিহ্নিত করে সময়মতো আত্মসচেতন হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নেওয়া কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করাও সহায়ক হতে পারে।

সম্পর্ক উন্নয়নে পারিবারিক, সামাজিক ও পেশাগত প্রয়োগিক কিছু টিপস:

পারিবারিক জীবন

  • একসঙ্গে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা
  • নিয়মিত পারিবারিক বৈঠক
  • পারস্পরিক দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া
  • বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন

সামাজিক জীবন

  • গুজব বা পরচর্চা থেকে বিরত থাকা
  • বন্ধুদের সাফল্যে খুশি হওয়া
  • সময়মতো শুভেচ্ছা জানানো
  • কারো বিপদে সাধ্যমত পাশে দাঁড়ানো
  • সহানুভূতির দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখা

পেশাগত জীবন

  • অফিস রাজনীতি এড়িয়ে চলা
  • সহকর্মীদের সঙ্গে সহযোগিতা ও শ্রদ্ধার আচরণ
  • সময়মতো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া
  • নেতৃত্বে থাকলে দমন নয়, উৎসাহ প্রদান করা

সম্পর্ক মানেই নিখুঁত বোঝাপড়া নয়, বরং বোঝার চেষ্টা—এটাই এর সৌন্দর্য। জীবনের প্রতিটি স্তরে সম্পর্কই আমাদের আশ্রয়, শান্তি এবং আত্মপরিচয়ের প্রতিচ্ছবি। তবে তা টিকিয়ে রাখার জন্য চাই যত্ন, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংবেদনশীলতা ও দায়িত্বশীলতা। আমাদের পারিপার্শ্বিক জীবনে স্বার্থ থাকবেই, তবে তা যদি ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবিক হয়, তাহলে সম্পর্ক ভাঙে না—বরং সময়ের সঙ্গে আরও গভীর ও দৃঢ় হয়ে ওঠে।

লেখক : ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক

মন্তব্য করুন

বিএনপির যত চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন হলো—আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য অগ্রগতি কতটুকু? বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া গণআন্দোলনের পর দেশে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের আশা উঁকি দিচ্ছে, যার প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্নটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিএনপির অনেক নেতা যেখানে প্রকাশ্যে ৯০ শতাংশ আসনে বিজয়ের আত্মবিশ্বাসের দাবি করছেন, সেখানে নবাগত ছাত্র-রাজনৈতিক দল এনসিপির নেতারা পাল্টা বিশ্লেষণে বলছেন, বিএনপি বড়জোর ৫০ থেকে ১০০টি আসন পেতে পারে। এ বিতর্কের মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা, সামাজিক বাস্তবতা এবং আঞ্চলিক রাজনৈতিক ডায়নামিকস—সবকিছুকে ছাপিয়ে ‘পরিস্থিতি’ শব্দটিই হয়ে উঠছে নির্ধারক ফ্যাক্টর। গত ২৮ জুন চরমোনাই পীরের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আহ্বানে আয়োজিত মহাসমাবেশে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কয়েকটি ইসলামপন্থি দল ‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (PR)’ পদ্ধতির দাবি তোলে। যদিও বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামো ও নির্বাচন পরিচালনার প্রচলিত রীতির আলোকে এ পদ্ধতি এখনই বাস্তবায়নযোগ্য কি না আলোচনার বিষয়; তথাপি এ প্রস্তাব একটি নতুন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করার চেষ্টা বলেই বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষ করে, বিএনপির ‘সুইং ভোটার’ বা নিরপেক্ষ ভোটারদের মনোজগতে একটি প্রভাব ফেলতেই এ কৌশল ব্যবহার হচ্ছে—এটি অস্বীকার করা যাবে না। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে—তারা ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (FPTP)’ ব্যবস্থাকেই সমর্থন করছে এবং এটিকে তারা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত, দ্রুত ফলপ্রসূ ও প্রত্যক্ষ গণমতের প্রতিফলনকারী একটি ভোটিং মেকানিজম হিসেবে তুলে ধরছে। তাদের মতে, এ ব্যবস্থার মাধ্যমেই একটি গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী নির্বাচন সম্ভব। কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে আরও বড় প্রশ্ন দাঁড়ায়—যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করে কিংবা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে, তাহলে বিএনপির বিজয় কতটা অর্থবহ হবে? এবং তারা আসলে কার সঙ্গে নির্বাচন করতে প্রস্তুত? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির সামনে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সিদ্ধান্ত হলো—এনসিপি বা জামায়াতের মতো রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্য জোট না গড়ে, বরং আদর্শিকভাবে ঘনিষ্ঠ ও মধ্যপন্থি দলগুলোর সঙ্গে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলা। এতে যেমন দলটির ‘ন্যাশনাল একসেপ্টেবিলিটি’ অক্ষুণ্ণ থাকবে, তেমনি ‘আনুপাতিক ভোট ব্যবস্থার’ নামে নির্বাচনী বিলম্বের মতো যে কোনো কৌশল মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো—দলীয় শৃঙ্খলা ও মাঠপর্যায়ের নিয়ন্ত্রণ। লন্ডন থেকে পরিচালিত এই রাজনৈতিক কাঠামো বাস্তব পরিস্থিতিতে কতটা কার্যকর হচ্ছে—সে প্রশ্ন এখনো বহাল। দলের একাংশে কোন্দল, চাঁদাবাজি, এমনকি সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে, যা বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষত তরুণ ভোটারদের মাঝে গঠিত হওয়া নতুন আশা-ভরসার প্রেক্ষাপটে। তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩২.৫% ভোট পেয়েও মাত্র ৩০টি আসনে জয়লাভ করেছিল। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৪৮.৪% ভোটে পেয়েছিল ২৩০টি আসন। এতে বোঝা যায়—ভোটের শতকরা হার ও আসনপ্রাপ্তির মধ্যে সরল সম্পর্ক নেই; বরং সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাই ফলাফল নির্ধারণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। অতএব, বিএনপির ৯০ শতাংশ আসনের প্রত্যাশা আপাতদৃষ্টিতে অতিরঞ্জিত মনে হলেও ১৫০ থেকে ১৭০টি আসন পাওয়া অসম্ভব নয়—যদি নির্বাচন সত্যিকার অর্থেই অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। এ মুহূর্তে বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি হতে পারে একটি সাহসী রাজনৈতিক ন্যারেটিভ, যা দমননীতি সত্ত্বেও টিকে থাকার প্রতিচ্ছবি। তবে তা কেবল প্রতিরোধ দিয়ে নয়, দায়িত্বশীলতা, পরিকল্পনা ও অংশগ্রহণমুখী কৌশলের মাধ্যমে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যদি একটি স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব হয়—তাহলে প্রথমবারের মতো বহু ভোটার তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক মতপ্রকাশের সুযোগ পাবেন। তখনই বোঝা যাবে, বিএনপি কতটা জনপ্রিয়, আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন কতটা অর্থবহ, জামায়াত ও এনসিপির বাস্তব উপস্থিতি কতখানি এবং নতুন প্রগতিশীল দলগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আদৌ তৈরি হয়েছে কি না। রাজনীতিতে গালভরা বক্তব্যের চেয়ে বেশি জরুরি হলো বাস্তব প্রস্তুতি, নীতিভিত্তিক অবস্থান এবং জনমুখী প্রতিশ্রুতি। কে কয়টি আসন পাবে বা কে জামানত হারাবে—এসব নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দেবে জনগণ, ব্যালটের মাধ্যমে। আর সেই রায়কে গ্রহণযোগ্য করতে হলে চাই একটি অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক এবং সব অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তবে যদি আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগবিহীন হয়, তাহলে বিএনপির জন্য অতীতের শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কীভাবে জনপ্রিয়তার চূড়ায় থেকেও আওয়ামী লীগ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, সেই অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বিএনপিকে তার রাজনৈতিক নীতি ও সাংগঠনিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তাহলেই দলটি আস্থার প্রতিদান দিতে পারবে এবং দেশ পেতে পারে একটি কার্যকর, টেকসই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সবশেষে, যদি আমরা সত্যিই গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চাই, তাহলে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার লোভ পরিহার করে ক্ষমতার ভারসাম্য ও রাজনৈতিক অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। পরস্পরের বিরুদ্ধে কথার লড়াই নয়; বরং নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা জনতার কোর্টে তুলে দেওয়াই হতে পারে গণতন্ত্রের নতুন সূচনা। আর সেই কোর্টের নামই—ভোটার। লেখক: দুবাই প্রতিনিধি, দৈনিক কালবেলা
বিএনপির যত চ্যালেঞ্জ
সনদ-সংস্কার: হনুজ দূর অস্ত
জুলাই সনদ ও সংস্কার নিয়ে লিখতে গিয়ে সাংবাদিক সাহিত্যিক যাযাবরের বহুল পঠিত ‘দৃষ্টিপাত’ গ্রন্থের কথা মনে পড়ে গেল। হয়তো কিছুটা প্রাসঙ্গিক হবে বিবেচনায় এখানে সেই কিংবদন্তি কাহিনির প্রসঙ্গ টেনে আনা। কাহিনি মোটামুটি এরকম— পাঠান সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি সে সময়ের দিল্লির একপ্রান্তে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। তার মৃত্যুর দীর্ঘকাল পর এক ফকির এলেন সেই মসজিদে। নাম নিজামউদ্দিন আউলিয়া। জায়গাটি তার পছন্দ হলো। সেখানেই রয়ে গেলেন এই মহাপুরুষ। ক্রমে ছড়িয়ে পড়ল তার পুণ্যখ্যাতি। দ্রুতবেগে বেড়ে গেল তার অনুরাগী ও ভক্তের সংখ্যা। স্থানীয় গ্রামে পানির অভাবের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। তিনি মনস্থির করলেন একটি দীঘি খননের। যেখানে তৃষ্ণার্তরা পানি পাবে, গ্রামের বধূরা কলসি ভরবে এবং নামাজের আগে অজু করে পবিত্র হবেন মসজিদের প্রার্থনাকারীরা। কিন্তু তার সংকল্প বাধা পড়ল অপ্রত্যাশিতরূপে। প্রবল পরাক্রান্ত সুলতান গিয়াসউদ্দিন তোগলকের বিরক্তিভাজন হলেন (তার দৃষ্টিতে সামান্য ফকির) নিজামউদ্দিন আউলিয়া। আউলিয়ার দীঘি কাটাতে মজুর চাই প্রচুর। গিয়াসউদ্দিনের নগর তৈরি করতেও হাজার হাজার মানুষ দরকার। অথচ দিল্লিতে মজুর সংখ্যা অত্যন্ত কম। দুই জায়গায় প্রয়োজন মেটানো অসম্ভব। অত্যন্ত স্বাভাবিক, সুলতান চাইলেন মজুররা আগে শেষ করবে তার কাজ, ততক্ষণ অপেক্ষা করুক ফকিরের খয়রাতি খনন। কিন্তু রাজার জোর অর্থের আর আউলিয়ার জোর হৃদয়ের, যার কোনো সীমা নেই। মজুররা দলে দলে কাটতে লাগল নিজামউদ্দিনের দীঘি। সুলতান হুংকার ছাড়লেন... ‘তবে রে...’ কিন্তু তার ধ্বনি আকাশে মেলাবার আগেই এত্তেলা এলো আশু কর্তব্যের। বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমনে ছুটতে হলো অনতিবিলম্বে। তোগলকের নগর প্রাচীর রইল অসমাপ্ত। অবশেষে সুলতানের ফেরার সময় হলো। প্রমাদ গুনলেন নিজামউদ্দিনের অনুরাগীরা। তারা নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে অনতিবিলম্বে নগর ত্যাগ করে পালানোর পরামর্শ দিল। আউলিয়া মৃদু হেসে তাদের নিরস্ত করলেন—‘দিল্লি দূর অস্ত’, অর্থাৎ দিল্লি অনেক দূর। এদিকে সুলতান প্রতিদিন যোজন পথ অতিক্রম করে নিকট থেকে নিকটবর্তী হচ্ছেন রাজধানীর পথে। প্রতিদিন ভক্তরা অনুনয় করে আউলিয়াকে। তিনি প্রতিদিন একই উত্তর দেন ‘দিল্লি দূর অস্ত।’ সুলতানের নগর প্রবেশের মাত্র একদিনের পথ অতিক্রমের অপেক্ষা। ব্যাকুল হয়ে শিষ্যরা অনুনয় করলেন আউলিয়াকে, ‘এখনো সময় আছে, এইবেলা পালান।’ গিয়াসউদ্দিনের ক্রোধ ও নিষ্ঠুরতার কথা কারও অজানা ছিল না। আউলিয়াকে হাতে পেলে কী দশা হবে তার, সে কথা কল্পনা করে ভয়ে শিউরে উঠল বারবার। মৃদু হেসে সেদিনও উত্তর দিলেন ভয়হীন আউলিয়া— ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।’ দিল্লি এখনো অনেক দূর। নগরপ্রান্তে সুলতানের জন্য অভ্যর্থনার আয়োজন করা হলো। স্থাপন করা হলো বিরাট মণ্ডপ। একটি হাতির শির সঞ্চালনে স্থানচ্যুত হলো একটি স্তম্ভ। মুহূর্তের মধ্যে শব্দে পতিত হলো সমগ্র মণ্ডপ। পরদিন ভোরে মণ্ডপের ভগ্ন স্তূপ সরিয়ে আবিষ্কৃত হলো বৃদ্ধ সুলতান এবং তার পুত্রের মৃতদেহ। দিল্লি রইল চিরকালের জন্য সুলতানের জীবিত পদক্ষেপে অতীত। অর্থাৎ ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত।’ বছর ঘুরে রক্তস্নাত জুলাই মাস ফিরে এসেছে। এক বছর হতে চললেও জুলাই সনদ ঘোষণা ও সংস্কার—কোনোটিই এখনো হয়নি। তাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, জুলাই সনদ ও সংস্কার কি ‘হনুজ দূর অস্ত’ অর্থাৎ এখনো অনেক দূর? এদিকে শুরু হয়েছে ২৪-এর ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণের পালা। আগামী ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের দিন পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। শুরু হয়েছে অভ্যুত্থানের এক বছরের সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে নানা সমীকরণ। জুলাই সনদ প্রসঙ্গে বলতে হয়, মৌলিক বেশ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও অনেক বিষয়ে এখনো মতভিন্নতা কাটেনি। মতভিন্নতা দূর করে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনীতির দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ চলছে। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সম্প্রতি জুলাই সনদ নিয়ে বলেছেন, ‘নানা বিষয়ে অগ্রগতি হলেও আশাব্যঞ্জক অগ্রগতির জায়গা থেকে আমরা এখনো খানিকটা পিছিয়ে আছি।’ অর্থাৎ জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়া থেকে এখনো ‘দূর অস্ত’, এখনো দূরে অবস্থান করছে। কমিশনের সহসভাপতি এর আগে বলেছিলেন, ‘জুন মাসের মধ্যে কমিশন জাতীয় ঐকমত্যের একটি সনদে পৌঁছাতে চায়। প্রত্যাশা ছিল শহীদ আবু সাঈদের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে সবাই মিলে এই সনদের স্বাক্ষর করতে পারব। সেটা হবে কি না, তা রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। আমরা হয়তো সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। তারপরও বিশ্বাস, জুলাই মাসের মধ্যেই সংলাপের একটি পরিণতি টানা সম্ভব হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস লন্ডন সফরের সময় গত ১২ জুন এক সংলাপে বলেছিলেন, ‘জুলাই মাসে দেশের সব রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিতে জুলাই সনদ ঘোষণা করে তার ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।’ অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে জুলাই সনদ ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত বলাই যায়, ‘সনদ... দূর অস্ত।’ জুলাই সনদ বিষয়টি গণঅভ্যুত্থানের শুরুতে বা চলাকালে অথবা পরেও ছিল না। তাহলে বিষয়টি প্রথমে জুলাই ঘোষণাপত্র ও পরে জুলাই সনদ কীভাবে সামনে এলো এবং এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন নেতা ও ছাত্র উপদেষ্টা অনেকটা আকস্মিকভাবে সামাজিকমাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জমায়েত হওয়ার ঘোষণা দেন। এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা জানান যে, ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ ঘোষণা করা হবে। অভ্যুত্থানের নেতারা তখন গণঅভ্যুত্থানকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেন। ছাত্রনেতারা একপর্যায়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগও দাবি করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জুলাই ‘প্রোক্লেমেশনের’ মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক ঘোষণা এবং ১৯৭২ সালের ‘মুজিববাদী সংবিধানের কবর’ রচনার ঘোষণা দেয়। প্রধান উপদেষ্টা সে সময় বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করেন। তার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই ঘোষণার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ঘটনার পর থেকেই জুলাই ঘোষণার বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার জুলাই সনদ ঘোষণার সময়সীমার কথা জানানো হলেও ওই সময়ের মধ্যে সরকার তা ঘোষণা করতে পারেনি। আইন উপদেষ্টা গত মে মাসে বলেছিলেন, জুন মাসের মধ্যে জুলাই সনদ ঘোষণা করা সম্ভব হবে। ছাত্রনেতাদের পক্ষ থেকে বারবার জুলাই ঘোষণার দাবি জানানো হয়। সর্বশেষ জুলাই মাসের শুরু হওয়ার প্রাক্কালে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জুলাই সনদ দিতে সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২৯ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘সরকার যেহেতু বলেছিল, সবার সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ দেবে, তা হয়নি। সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এজন্য ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে আগামী ৩ আগস্ট জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হবে।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ বর্তমান পর্যায়ে কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। যার দরুন দ্বিতীয় পর্বে সাত দিন আলোচনা শেষেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে রয়েছে—সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, উচ্চকক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া, দায়িত্ব ও ভূমিকা, উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হবে; এ নিয়েই বেশি মতবিরোধ চলছে। উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে অনেক দল সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির কথা বলেছে। তবে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এর স্পষ্ট বিরোধিতা করেছে। বিএনপি চায় সংসদে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। জামায়াত, এনসিপিসহ বাকি দলগুলো চাইছে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন। চার দিন ধরে এ বিষয়ে আলোচনা হলেও সমঝোতা হয়নি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়েও মতভিন্নতা রয়েছে। ২ জুলাই ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে একমত সংস্কারের সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। তবে গঠন পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে। গত ২০ মার্চ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেও এখন পর্যন্ত ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করতে পারেনি। জুলাই মাসে সবার দৃষ্টি জুলাই সনদের দিকে। বহুল প্রত্যাশিত এই সনদে কী থাকবে, ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী, কর্তৃত্ববাদী অথবা ফ্যাসিবাদী শাসনের পুনরুত্থানরোধ করতে জুলাই সনদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কি না, তা জানার আগ্রহ সবার। নির্বাচন হবে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। আগামী বছরের শুরুতে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা শুরু করবে—এমনটাই জনগণের প্রত্যাশা। জুলাই সনদ নিয়ে সংলাপ চলমান থাকলেও অন্যান্য সংস্কার যেমন জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুদক, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারীবিষয়ক ও গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। এর মধ্যে কোনো কোনো সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনার জন্য উপদেষ্টাদের নিয়ে কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটি আবার কতদিন পর তার সুপারিশ তৈরি করবে, তা দেখার বিষয়। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, গণমাধ্যম কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তিন মাসেরও বেশি সময় পর পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব বিষয়ের সংস্কার নিয়ে সেই একই কথা বলতে হয়—সংস্কার... ‘হনুজ দূর অস্ত।’ সংস্কার... এখনো অনেক দূর। লেখক: কলাম লেখক
সনদ-সংস্কার: হনুজ দূর অস্ত
ময়ূর কি ফিরবে
ময়ূরের পেখম কেন চোখের মতো দেখায়? এ নিয়ে উত্তর রামায়ণে একটি গল্প আছে। ইন্দ্র একবার রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে পারছিলেন না। এক প্রকার পরাস্ত হয়ে ইন্দ্রদেব যার ডানার নিচে লুকিয়েছিলেন, তিনি হলেন এই ময়ূর। পরে দেবতা ইন্দ্র খুশি হয়ে ময়ূরকে হাজার চোখ দান করেছিলেন। সেই চোখগুলোই ময়ূরের পেখমে দেখা যায়। আরও একটি বর তিনি দিয়েছিলেন, সেটি হলো সাপকে পরাস্ত করার শক্তি। হিন্দুদের কাছে তাই এ ময়ূর অনেক বেশি পবিত্র। পবিত্র আরও একটি কারণে, সেটি হলো, এ দেবতা ইন্দ্রেরই বাহন হলেন ময়ূর। এ ছাড়া হিন্দুদের আরাধ্য দেবতা ভগবান কৃষ্ণের মাথায় যে পালকটি দিয়ে শোভিত করা হয়, সেটি আসলে ময়ূরের পাখা। ময়ূর দেখতে খুবই চমৎকার। এর রং অনেক আকর্ষণীয়। বিশেষ করে এর পালক অনেক উজ্জ্বল আর সবুজ-নীল রঙের। পালকে চোখের মতো ফোঁটা ফোঁটা দাগ থাকে। ময়ূর সাধারণত ৮৬ সেমি লম্বা হয়। কিন্তু পালকসহ হিসাব করলে এর দৈর্ঘ্য হয় ২ থেকে ২.৫ মিটার। ময়ূর আর ময়ূরী চিনবেন কীভাবে? ময়ূরীর পেখম মেলার মতো লেজে উজ্জ্বল লম্বা পালক থাকে না। ঘাড়ের নিচের দিকটা উজ্জ্বল সবুজ রঙের হয়। এর পেট সাদা রঙের আবার এর সঙ্গে কিছুটা হলুদ রঙের আভাও থাকে। পালকগুলো পাখার মতো থাকে। পুরুষ ময়ূরের ঠোঁট থেকে লেজের দৈর্ঘ্য হয় ১০০ থেকে ১২০ সেমি। এর ওজন ৪.১ থেকে ৫.২ কেজি। স্ত্রী ময়ূরের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৮ সেমি থাকে। ওজন হয় ২.৭ থেকে ৪.১ কেজি। স্ত্রী ও পুরুষ উভয় ময়ূরেরই চোখ হয় বাদামি রঙের, ঠোঁট আর পা-ও বাদামি রঙের হয়ে থাকে। এরা সাধারণত বন, ছোট ছোট পাহাড়, জলের কাছাকাছি কোনো জায়গায় থাকে। ঝোপঝাড় আর আবাদি জমির পাশেও এদের দেখা যায়। মানুষের ঘরের কাছাকাছি অনেকটা গৃহপালিত পাখির মতোও এরা থাকতে পারে। এ ময়ূরগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বেরিয়ে পড়ে খাবারের সন্ধানে। মাটিতে খাবার খুঁজে বেড়ায় এরা। এরা সর্বভুক। ঘাস, শস্য বীজ, ফুলের কুঁড়ি, ফল, পোকামাকড়, ছোট ছোট সরীসৃপ এদের খাবার। এরা সাপ খায়। ছোট ছোট সাপ খেতে দেখা যায়। চাষের জমিতেও এরা খাবার খায়। কাছাকাছি জলাশয় থাকলে হেঁটে হেঁটে সেই জলাশয়ের কাছে যায় দল বেঁধে। চাষের জমিতে চীনাবাদাম, টমেটো, ধান, মরিচ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এক-একটি দলে একটি ময়ূর ও অন্যান্য তিন থেকে পাঁচটি ময়ূর থাকে। আবার অনেক সময় বিশেষ করে প্রজনন সময়ের পর এক-একটি দলে স্ত্রী ও শাবকরা থাকে। ময়ূররা একেক সময় একেকভাবে থাকে। যেমন ভোরবেলায় এদের খোলা জায়গায় দেখা যায়। আস্তে আস্তে দিনের তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এরা আড়ালে চলে যায়। সন্ধ্যার দিকে এরা প্রায়ই ধুলোবালিতে থাকে। এদের বাসা সাধারণত লম্বা লম্বা গাছে দেখা যায়। তবে পাথরের গর্তেও দেখা গেছে। আবার বিভিন্ন ভবনেও এদের বাসা বানাতে দেখা গেছে। অন্যান্য পাখির মতো ময়ূররাও সন্ধ্যায় তাদের বাসার কাছে আসে। ঘন ঘন ডাকতে থাকে। এরা উড়তেও পারে। প্রধানত হাঁটে। ভয় পেলে গাছ বেয়ে ওপরে উঠে পড়ে। বাংলাদেশে নীল ময়ূর দেখা আগে মিললেও বর্তমানে প্রজাতিটি বিলুপ্ত। একসময় শালবনে এটি থাকলেও এখন আর দেখা যায় না। একটি তথ্যমতে, সর্বশেষ ১৯৮২ সালের দিকে মধুপুর জাতীয় উদ্যানে নীল ময়ূর দেখা গেছে। বন বিভাগ সম্প্রতি এ প্রজাতিটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনের গভীরে সবুজ ময়ূর পাওয়া গেলেও এ প্রজাতিটিও হারিয়ে যাওয়ার পথে। এসবের বিলুপ্তি হওয়ার বড় কারণ আবাসস্থল ধ্বংস। বন থেকে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া আগ্রাসী উদ্ভিদও একটি কারণ। তা ছাড়া রয়েছে পাখি পাচারের ঘটনা। কীটনাশক আর আগাছানাশক ব্যবহারের কারণে পোকামাকড়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে ময়ূরের ওপর। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের বিষয়গুলো তো আছেই। তবে আশার কথা হলো, গত ২৬ মে টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর শালবনে দোখলা রেঞ্জের লহরিয়া বিটে পাঁচ জোড়া ময়ূর অবমুক্ত করা হয়েছে। যদিও অনেকে এগুলো থাকতে পারবে কি না, এ নিয়ে সন্দেহ করছেন। কেননা বনের পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, অভিযোজন এ বিষয়গুলোও ভাবার রয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী হতে চাই। এ নিয়ে প্রয়োজনে আরও গবেষণা করার প্রয়োজন পড়লে করা হোক। কী করলে নীল ময়ূরগুলোকে তাদের আবাসভূমিতে ফিরিয়ে আনা যাবে, তা নিয়ে কেউ কেউ ভাবছে এটাই আশার কথা। তবে শুধু আশা করলে হবে না বা পাখি অবমুক্ত করলেই হবে না; পাখিকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে চাইলে আগে ঘরকে তো ঠিক করতে হবে। সেই ঘরও ঠিক হোক। তবেই না দেখা মিলবে নীল ময়ূরের যৌবন। লেখক: শিক্ষক ও গবেষক
ময়ূর কি ফিরবে
জোহরানের জয় ও বৈশ্বিক প্রভাব
আসন্ন নভেম্বরের ৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হবে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ও জনবহুল শহর, নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচন। সাধারণ নির্বাচনগুলোতে নিজেদের প্রার্থী মনোনয়নের আগে দেশটির প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল, রিপাবলিকান পার্টি এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের আয়োজন করে থাকে, যা ‘প্রাইমারি ইলেকশন’ নামে পরিচিত। জুন মাসের ২৪ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় ডেমোক্র্যাট দলের প্রাইমারি ইলেকশন, যেখানে মোট ১২জন প্রার্থীর প্রতিযোগিতায় জয় লাভ করেন নিউ ইয়র্ক রাজ্যের আইনসভার নেতা জোহরান মামদানি। নিউ ইয়র্কের সাবেক গভর্নর এন্ড্রু কুয়মোকে হারিয়ে একাই ৫৬% ভোট নিশ্চিত করেন তিনি। সদ্য বিজয়ী এই যুবকের পরিচয় হলো, তিনি একজন আফ্রো-এশীয় বংশোদ্ভত মুসলিম। আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তিনি তার রাজনৈতিক যাত্রার শুরু থেকেই নিজেকে প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্রী হিসেবে দাবি করে আসছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে প্রবেশের পর থেকে মার্কিন জনসচেতনা ধীরে ধীরে এক দীর্ঘ নিদ্রায় ঢলে পড়েছিল। মামদানির এই বিজয় যেন মার্কিন নাগরিকদের সেই নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলেছে। তবে এখনই আনন্দ উদযাপন করছে না ডেমোক্র্যাট দলের সমর্থকরা। কারণ মামদানি কেবল প্রথম ধাপ পার করেছেন। এটি দীর্ঘ এক সংগ্রামের সূচনা মাত্র। পাশ্চাত্যের উদারপন্থী ও প্রগতিশীল গোষ্ঠীগুলো লড়ছে এক বৈশি^ক রক্ষণশীল, জাতীয়তাবাদী ও ফ্যাসিবাদী ডানপন্থী উত্থানের বিরুদ্ধে, সাম্প্রতিককালে যার প্রভাব বিস্তৃত হতে দেখা গেছে গোটা ইউরোপ জুড়ে। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুটি গণতন্ত্রÑভারত ও আমেরিকার রাজনৈতিক পরিসরকেও গ্রাস করে ফেলেছে এই চরমপন্থী রক্ষণশীলতা ও জাতীয়তাবাদ। আমার এক বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক একবার বলেছিলেন, ‘যদি বিংশ শতাব্দী হয় মতাদর্শের শতাব্দী, তবে একবিংশ শতাব্দী হল প্রযুক্তির শতাব্দী।’ তার বক্তৃতায় তিনি দাবি করেছিলেন যে, যেই অভাবনীয় গতিতে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটছে, তাতে মানব সভ্যতার অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত বহু সংকট শীঘ্রই নিরসন হয়ে যাবে। যেই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য অতীতে তাত্তি¡ক কাঠামো তৈরি করতে হত, তা এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করেই সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানকালের বৈশি^ক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে, এই দাবি আমরা পুরোপুরি গ্রহণও করতে পারি না, আবার একেবারে বর্জনও করে দিতে পারি না। উপরন্তু একবিংশ শতাব্দীর মাত্র এক চতুর্থাংশ পার হয়েছে। আগে যেই পরিবর্তন আনতে যুগের পর যুগ সময় লেগে যেত, এখন তা কয়েক মাসের ব্যবধানে ঘটানো সম্ভব। তবে এই পরিবর্তন যে সব সময় ইতিবাচক, তা কিন্তু নয়। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অহিতকর পথেও দেশ, জাতি ও মানুষকে ধাবিত করা যায়। বিশ্ব আর আগের মতো নেই। এখন এটা যেমন আছে, ভবিষ্যতেও আর তেমন থাকবে না। তবে বর্তমানকালে অর্থনৈতিক পরিবর্তন, উদ্ভাবনের নতুন ধারা, রাজনৈতিক ও নৈতিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের পেশার রূপান্তর, বিশ্বাস ও আগ্রহের বিবর্তন এবং সামাজিক কাঠামোর এক আমূল পরির্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। গোটা বিশে^র উন্নত, উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশ, সবগুলোই দোদুল্যমান এক বুদ্ধিবৃত্তিক ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে যেমন চরমপন্থীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, অন্যদিকে তার প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিরোধ গড়তে বিপরীত পক্ষও অস্থির হয়ে পড়ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, একটা চ‚ড়ান্ত অনিশ্চিয়তার সময় পাড় করছি আমরা। সংখ্যাটা কম হলেও এই সময়ে যারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী, তারা আপাতত কোনো পক্ষে অন্ধ আস্থা রাখছেন না, কোনো নেতার ফাঁকা বুলির মোহে পড়ছেন না, কিংবা কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনায় নিজের সম্পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছেন না। বর্তমানে পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো, যারা তৃতীয় বিশ্বের নবীন রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এবং দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে প্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে, তারাও আজ এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে। বিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর জাতিরাষ্ট্রের ধারণা যেই সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, আজ তা ভেঙে পড়ছে চরমপন্থী ও বর্ণবাদী রাজনীতির চাপে। ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো ইউরোপে ভীতির সঞ্চার করেছে। পশ্চিমা বিশে^র সরকারগুলো বর্তমানে আতঙ্কিত প্রাচ্যের এমন এক শক্তিকে নিয়ে, যা এখনো একনায়কতন্ত্র বা রাজতন্ত্রের ছায়া থেকে সরে আসতে পারেনি; যার স্মৃতিতে এখনো সাম্যবাদের লাল পতাকা দীপ্ত। এদিকে, যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার ঘটনা মূলত ডানপন্থী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তত্তে¡ বিশ্বাসী রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে সংঘঠিত হয়েছে। বর্তমানে দেশটির দুই ঐতিহ্যবাহী প্রধান দল, কনজারভেটিভ পার্টি ও লেবার পাটির অনেকখানি ক্ষমতা দখল করে তারা নিজেদেরক মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন লেবার সরকারের গ্রহণযোগ্যতা দ্রæত হ্রাস পাচ্ছে বিধায় ব্রিটেনে আবারও একবার লেবার পার্টির বাম ঘরানার জাগরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ধারা শুধুমাত্র ব্রিটেনেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি এখন সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে। মধ্যপন্থীরা দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং ডানপন্থী ও বামপন্থীরা ধীরে ধীরে চরমপন্থী হয়ে উঠছে। ফ্রান্সে মেরিন লে পেনের উগ্র ডানপন্থী জোট এবং জাঁ-লুক মেলেশর বামপন্থী আন্দোলনের ঊর্ধ্বগতি এই বাস্তবতারই আরেকটি প্রতিফলন। জার্মানিতে চরমপন্থী দল ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ এর জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ছে যে, জার্মানির সংসদে তারা এখন দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। আইন সভার নিম্নকক্ষে সরকারি দল ‘খ্রিস্টান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন’-এর থেকে মাত্র ১৩টি আসন কম তাদের। ইতালিতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আছেন ‘ব্রাদার্স অফ ইতালি’ নামের ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী দলের প্রেসিডেন্ট জর্জিয়া মেলোনি। পর্তুগালে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী দল ‘চেগা’ ও স্পেনে ডানপন্থী সংরক্ষণশীল দল ‘ভক্স’ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন যে, ইতালির স্বৈরশাসক অ্যান্তনিও সালাজার ও স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর মতন একনায়কদের ফ্যাসিবাদী পথে ভবিষ্যতে আবারো হাটতে পারে এই দুই দেশ। এই অবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রথাগত মধ্যপন্থী ও প্রগতিশীল বামপন্থী শক্তিগুলো আজ তাদের আত্মপরিচয় ও প্রতিরোধের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। তাড়াহুড়ো করে জোড়াতালি দেওয়া এক একটি নীতিহীন জোট গঠন করা ছাড়া এই মুহূর্তে তেমন কিছু করতে পারছে না তারা। তবে সেই জোটগুলোরও না আছে আদর্শ, না আছে জনসমর্থন। এভাবেই ক্ষমতা চর্চার সুযোগ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশে^র মধ্যপন্থীরা। কীভাবে ফ্যাসিস্টদের ডানপন্থী উত্থানকে সাময়িকভাবে প্রতিহত করা যায়, সেই পরিকল্পনা করছে তারা। এই ব্যর্থতার কারণে বৈশ্বিক রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে উগ্রবাদীদের হাতে। ব্রিটেনে ‘রিফর্ম ইউকে’ নামের ডানপন্থী দল সাম্প্রতিক জনমত জরিপে লেবার পার্টিকে ছাড়িয়ে গেছে। ক্ষমতাধর লবিগুলোর মন জয় করতে এবং সাময়িক জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে লেবার পার্টি তাদের মৌলিক আদর্শগুলোকে বিসর্জন দিয়েছে। ভবিষ্যতে এই সিদ্ধান্তের পরিণতি ভোগ করতে হবে তাদেরকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও একই ভুল করেছে। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের উত্থানের পর, তাদের যেই দুটো শিক্ষা হওয়া উচিৎ ছিল, তার কোনোটিই হয়নি তাদের। প্রথমত, তারা কর্মহীন ও অদক্ষ মার্কিন নাগরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে উগ্র ডানপন্থীদের অভিবাসনবিরোধী ক্ষোভ জাগানোর ক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেছিল। দ্বিতীয়ত, তারা ভুলে গিয়েছিল যে এই লড়াইয়ের মূল চালিকা শক্তি আদর্শগত নয়, বরং বস্তুগত। ভার্মন্ট রাজ্যের সেনেটর ও ডেমোক্র্যাটিক দলের নেতা বার্নি স্যান্ডার্স এই বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করেছিলেন এসব বঞ্চিত ভোটারদের আবারও ডেমোক্র্যাটিক দলে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু সফলতার মুখ দেখতে পাননি তিনি। অধিকন্তু গাজার যুদ্ধে জো বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। এটা ২০২৪ সালের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসের প্রার্থীতা থেকে হাজার হাজার মুসলিম, আরব-আমেরিকান ও বামপন্থী ভোট হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতিতে জোহরান মামদানি নভেম্বরে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে জয় লাভ করবেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। নেতানিয়াহু ও ইসরায়েলের বিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রচারণা করেছেন তিনি। আমেরিকায় ইহুদি জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় ঠিকানা নিউইয়র্ক শহর, যাদের মধ্যে অধিকাংশেরই সমর্থন মামদানির বিপক্ষে। তবে একটি বিষয় তিনি তার দলকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন নীতির প্রতি নিষ্ঠা ছাড়া কোনো বিজয় অর্জন সম্ভব নয়, তাতে যত বড় ঝুঁকিই থাকুক না কেন। মামদানি জানেন, ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিউ ইয়র্কবাসীর মন জয় করা সম্ভব নয়। তাদের দাবিদাওয়াগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয়া এবং তাদের সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। ফক্স নিউজের মত গণমাধ্যমগুলোর প্রচারণা বা বৈদেশিক লবিগুলোর সমর্থন, কোনোটাই তার বিজয় এনে দিতে পারবে না। নিউ ইয়র্কবাসীদের ভোট নিশ্চিত করতে হলে চাই চলমান সংকটগুলোর বাস্তবসম্মত সমাধান। প্রযুক্তির বিশদ বিস্তার ঘটলেও মানুষের প্রধান চাহিদাগুলো আজও সেই একই রয়ে গেছে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাথ্যসেবা এবং সামাজিক নিরাপত্তা। লেখক: ব্রিটেন ভিত্তিক আন্তর্জাতিক পত্রিকা ‘আশরাক আল-আওসা’ এর নির্বাহী সম্পাদক। নিবন্ধটি আরব নিউজের মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
জোহরানের জয় ও বৈশ্বিক প্রভাব
চালে চালবাজি: কারসাজি কোথায়
চালে চালবাজি: কারসাজি কোথায়
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ
চারদিক / বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ভূতের আক্রমণ
গণতন্ত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হোক জুলাই
গণতন্ত্রের আলোয় উদ্ভাসিত হোক জুলাই
সান্ত্বনা খোঁজার অবকাশ কোথায়!
সান্ত্বনা খোঁজার অবকাশ কোথায়!